”স্যার, আমি রংপুর কারমাইকেলের স্টুডেন্ট”

এই খালি, যাবা? -কোথায় যাবেন, স্যার? পান্থপথ বসুন্ধরা সিটির পেছনে, পূর্ণিমা সিনেমা হলের গলি। আবাহনী মাঠের বাম পাশ দিয়ে যাবা। আপনি চিনায়ে নিলে যাব। আমি ভালমতো চিনি না। এই এলাকায় নতুন আসছি। নতুন হইলে তো সমস্যা। কোন সমস্যা নাই স্যার। খালি রাস্তাটা চিনায়ে দিবেন। সেটা না হয় দিলাম। কিন্তু ভাড়া কত দেব? -আপনি যান না, স্যার? যা ভাড়া তা-ই দিয়েন। আমাকে না ঠকাইলেই হইল। আমি তো রেগুলার ৬৫-৭০ টাকা করে যাই। -আচ্ছা, ওঠেন স্যার। কোন সমস্যা নাই। সংলাপের স্থান রায়েরবাজার হাশেম খান রোড। সময় শুক্রবার বিকাল চারটা। বাপ-বেটা চড়ে বসলাম। তরুণ রিক্সাওয়ালাও প্যাডেলে দুই পায়ের ওঠা-নামা শুরু করল। সাধারণত রিক্সাওয়ালাদের পরনে লুঙ্গি থাকলেও এই তরুণের পরনে নীল জিন্স প্যান্ট আর ভি-গলার সবুজ হাফ হাতা গেঞ্জি। ব্যাপারটা তবু কেন যেন গুরুত্ব দিলাম না। ইয়াং ছেলে, জিন্স পরতেই পারে। পেছন থেকে প্রয়োজনীয় স্থানে ‌’ডানে যাও’, ‘এইবার বামে যাও’ এইসব নির্দেশনা দিতে থাকলাম। মুক্তি সিনেমা হলের সামনের মধুবাজারের গলি দিয়ে কিছু সময়ের মধ্যেই আবাহনী মাঠের বাঁ পাশে এসে ছেলেকে নামিয়ে দিলাম। (ক্রিকেট প্র্যাকটিসের জন্য বেশিরভাগ দিনই অফিসে আসার পথে এভাবেই ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে আসি। সন্ধ্যার আগে আগে ওর মা এসে নিয়ে যায়।) রিক্সা আবার চলতে শুরু করল। মিনিট বিশেকের মধ্যে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের পেছন দিকের রাস্তা হয়ে পান্থপথ দিয়ে গন্তব্যে এসে পৌঁছালাম। এবার ভাড়া মিটানোর পালা। মানিব্যাগ থেকে বের করে ৭০ টাকা দিলাম। ‘স্লামালিকুম স্যার, ভাল থাকবেন’-টাকাটা হাতে নিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে জবাব দিল রিকশাচালক তরুণ। টাকা পেয়ে সালাম দিয়ে কোন রিকশাওয়ালার বিদায় নেবার অভিজ্ঞতা অতীতে কখনো হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। সঙ্গত কারণেই কিছুটা ধাক্কা খেলাম। ‘এই, তুমি কি পড়াশোনা কর নাকি?’ মাথা নেড়ে সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞাস করলাম ওকে। -জি স্যার, আমি রংপুর কারমাইকেলের স্টুডেন্ট। ‘তুমি কারমাইকেল কলেজের ছাত্র!?’ বিস্ময়ে চোখ দুটো কপালে ওঠার যোগাড়। -জি স্যার। ‘তুমি কারমাইকেলে পড়!?’ সন্দেহ দূর করতে দ্বিতীয় দফা একই প্রশ্ন করলাম। -জি স্যার, আমি অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ি। যথেষ্ট আস্থার সঙ্গে জবাব দিল ছেলেটি। অনার্স থার্ড ইয়ার? কোন সাবজেক্ট? -পলিটিক্যাল সাইন্স। নাম কি তোমার? -মোমিনুল। ইন্টারমেডিয়েট পাশ করেছ কোন কলেজ থেকে? -বিরামপুর ডিগ্রি কলেজ। দিনাজপুরের বিরামপুর? -জি স্যার। এভাবে আরো তিন-চার মিনিট কথা চলল। মোমিনুল জানাল সে পরিবারের বড় ছেলে। তারা তিন ভাই। মেজো ভাই বিরামপুর কলেজে ইন্টারমেডিয়েটে, ছোটজন স্থানীয় হাইস্কুলে পড়ছে। বিরামপুর কলেজের কাছেই তাদের বাড়ি। বাবা এলাকায় ভ্যান চালান। তাতে সংসার চলে না। নিজের ও ছোট ভাইদের পড়াশোনার খরচ যোগাতে তার ঢাকায় আসা। এলাকার পরিচিত আরও কয়েকজন ঢাকায় রিক্সা চালান। তাদের মাধ্যমেই সে এ কাজ জুটিয়েছে। এর আগেও দুইবার খন্ডকালীন রিক্সা চালানোর কাজে সে ঢাকায় এসেছিল। মোমিনুল বলল তার নিয়মিত ক্লাস করা হয়ে ওঠে না। সামনে ফরম ফিলাপের জন্য বাড়তি টাকা লাগবে। আপাতত কলেজেও ক্লাস তেমন নেই। সে কারণেই এ সময়টা রিকশা চালানোর জন্য বেছে নিয়েছে সে। আলাপে আরো জানা গেল, কয়েক বছর আগে বন্যায় মোমিনুলদের বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যা তাদের একেবারে পঙ্গু করে দিয়ে গেছে। চরম দারিদ্রের কারণে তার দুইবার ব্রেক অফ স্টাডিজও হয়েছে। ‘এই খালি, সোবহানবাগ যাইবা?’ -আপনি চিনায়ে নিলে যাব। ‘ঠিক আছে, রিক্সা ঘুরাও।’ -আসি স্যার। দোয়া করবেন। সোবহানবাগের যাত্রী নিয়ে উল্টো ছুটতে শুরু করল মোমিনুল। অনেকটা ভ্যাবাচেকা খাওয়ার মতো ওই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকলাম, যেখানে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল মোমিনুলের সঙ্গে। রাজ্যের ভাবনা এসে মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল। অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে একটা ছেলে ফরম ফিলাপের টাকা সংগ্রহের জন্য ঢাকায় এসে রিক্সা চালাচ্ছে! অথচ এই রাজধানীতেই মৌজ-মাস্তি করে প্রতিদিন বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় কোটি কোটি টাকা উড়াচ্ছে ধনীর দুলাল-দুলালীরা। এদের একমাসের অপচয় করা টাকায় এ রকম কত শত মোমিনুলের পড়ালেখা সুসম্পন্ন হতো, সে কথা কে ভাববে! মুক্তবাজার অর্থনীতি বলে কথা। কার জন্য কার এত ঠেকা পড়েছে! দ্রুতই দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল মোমিনুলের রিক্সা। নিজেও এগোতে থাকলাম অফিসের দিকে। [ রবিবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রায়েরবাজার, ঢাকা]
দৈনিক ইত্তেফাকের যুগ্ম-সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেনের ফেসবুক থেকে নেয়া

Next Post

পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইন আপই রেকর্ড বইয়ে যুক্ত করেছে গাদাখানেক রেকর্ড।

রবি সেপ্টে. ২ , ২০১৮
Ava Desk : রেকর্ড গড়াই হয় ভাঙার নিমিত্তে। তবে কয়েক ম্যাচের ব্যবধানে একগাদা রেকর্ড ভাঙার ঘটনা খুব কমই দেখা যায়। কিছুদিন আগে সমাপ্ত পাকিস্তান–জিম্বাবুয়ে সিরিজে সেই চমক দেখিয়েছেন খেলোয়াড়েরা। বলতে গেলে পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইন আপই রেকর্ড বইয়ে যুক্ত করেছে গাদাখানেক রেকর্ড। ফখর জামান, তরুণ ইমাম উল হকরা রানের বন্যার পাশাপাশি […]

এই রকম আরও খবর

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links