সব সত্যের মাঝে কিছু সত্য এই যে, যা দেখা যায় তা আসলে দেখতে ভুল ছিল।

আভা ডেস্কঃ এক. অবশেষে রিফাত হত্যাকাণ্ডে স্ত্রী মিন্নি গ্রেফতার হয়েছেন। এটাই হওয়ার কথা ছিল। আলোচনার আগে লেখক সাংবাদিক মাসকাওয়াথ আহসানের অতিসম্প্রতি রচিত একটি স্যাটায়ার নিয়ে কথা বলি। ‘মাথা ক্রয় কেন্দ্র’ শিরোনামে স্যাটায়ারটির একটি অংশে বলা হয়েছে, কিভাবে একটি বিষয়কে টেনে আরেকটি বিষয়কে ঢেকে দিতে হয়।

স্যাটায়ারে বলা হয়েছে, কোনো ধর্ষণের বিষয় আড়াল করতে ধর্ষিতার পোশাক ও চরিত্র নিয়ে টান দেয়ার কথা। এখনতো দেখি রিফাত হত্যাকাণ্ডেও তাই হচ্ছে। একজন তরুণ প্রকাশ্যে খুন হলো। তাকে কুপিয়ে খুন করা হলো। তাও করলেন প্রভাবশালীদের ছাও-পাওয়েরা। আর সেই হত্যাকাণ্ডের প্রধান সাক্ষী ছিলেন মিন্নি। এখন প্রধান সাক্ষীই আসামী!

নয়ন বন্ড তো গেছেই এখন রয়েছে ফারাজী ব্রাদার্স। নয়ন তো চামচা, আর ফারাজী ব্রাদাররা আপন লোক। সুতরাং প্রধান সাক্ষীই যদি আসামী হয়ে যায়, তবে আর সাক্ষী কই। প্রকাশ্যে একজন তরুণকে কুপিয়ে হত্যার দৃশ্য দেখা কূপমন্ডু করা তো আর সাক্ষী হতে আসবে না. সাক্ষী হতে আসবে এখন সাক্ষীগোপালরা। ফলাফল কী হবে তা অনুমান করা খুব দুঃসাধ্য নয়।

বরগুনা প্রেসক্লাবের সম্মুখের মানববন্ধনে যখন প্রভাবশালীরা মূল আসামীদের বাদ দিয়ে মিন্নির গ্রেফতারের দাবীতে এবং তার আলোচনাতেই ব্যস্ত ছিলেন; তখনই বোঝা গিয়েছিল কী ঘটতে যাচ্ছে। সেই মানববন্ধনে অবশ্য নিহত রিফাতের বাপ-চাচারাও ছিলেন। কিন্তু কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বাপ-চাচার চেয়ে অন্যরাই ছিলেন বেশি প্রতিবাদী।

অর্থাৎ মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ ছিল বেশি। সর্বশেষ গ্রেফতার হওয়ায় এই মিন্নিই এখন আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। তার চরিত্র, তার ভিডিও ক্লিপ নিয়ে রসালো সব আলোচনা। আর এই আলোচনার আড়ালে রিফাত হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা, ফারাজী ব্রাদারদের কথা সব উধাও।

সঙ্গে উধাও প্রভাবশালীদের যোগসাজশ। নয়নবন্ড আর ফারাজী ব্রাদারদের ক্ষমতার উৎস তো আর গোপন নয়। এখন সবাই দুধে ধোয়া, শুধু দোষী হলো মিন্নি। কিন্তু তারপরেও কি দোষ আড়াল করা সম্ভব? আদালতে খুনিও তো নিজেকে নির্দোষ দাবী করে।

দেশে এই যে দোষ আড়ালের মচ্ছব চলছে।

একটা বিষয় নিয়ে কথা শুরু হতে না হতেই, আরেকটা বিষয় দিয়ে তা ঢেকে দেয়া হচ্ছে। এই যে ঢেকে দেয়া বা ঢেকে রাখার প্রক্রিয়া, তা কিন্তু ক্রমেই দেশটাকে একটা না ফেরার জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। ‘আউট ল’দের ‘ল্যান্ডে’ পরিণত করার কোশেশ চলছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে।

যার ফলশ্রুতিতে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘মব জাস্টিস’। মানুষ ‘মব’ প্রিয় হয়ে উঠছে। এখন যারা একে সমর্থন করছেন, ভাবছেন ‘সাপোর্টেড মব জাস্টিসে’র আড়ালে অন্য ‘লিঞ্চিং’গুলোও আড়াল হয়ে যাবে, তাদের জন্য আখেরে রয়েছে আফসোস। ‘মব’ সৃষ্টি হলে তা আর কাউকে দেখে না, তখন মানুষের আবেগিক প্রক্রিয়ায় বিবেক লোপ পায়। সে সময় কে হোমড়া আর কে চোমড়া তার কিছুই হুশে থাকে না।

দুই.

ঢাকার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে দেখলাম শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন পোড়ানোর মচ্ছব হলো। পাঁচশ মোবাইল ফোন পোড়ানো হয়েছে এমনটাই জানালো গণমাধ্যম। আমি জানি না, এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কে। তবে এমন ঘটনা যে প্রতিষ্ঠানে ঘটে, সেখানের প্রধান এর দায় এড়াতে পারেন না।

জানি তাদের ব্যাখ্যা হবে, মোবাইল ফোনের কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটছে। আরে, পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটছে তো আরও নানা কারণে। ‘আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ’ ধরণের পড়াশোনার ব্যাঘাত নিয়ে বড় কথা বলা সঙ্গত কিনা, তা না ভেবে শিক্ষার্থীদের মোবাইল পোড়ানো নিশ্চিত বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

মোবাইল ফোনের ভালো দিকটা কি একবার ভেবে দেখেছেন ওই প্রতিষ্ঠানের ওই পণ্ডিতগণ? হালের পরিস্থিতিতে একটা বাচ্চা বাসা থেকে বের হলে, তারা ঘরে ফিরতে পারবে কিনা সেই নিশ্চয়তা কি ওই প্রতিষ্ঠানের পন্ডিতগন দিতে পারবেন? একটা মোবাইল ফোন বাবা-মাকে যেমন নিশ্চিন্ত রাখতে পারে, তেমনি হতে পারে সংঘটিত অপরাধের সূত্রও।

একটা বাচ্চাকে পাওয়া যাচ্ছে না, তার সর্বশেষ লোকেশনসহ অনেক কিছুরই উত্তর মিলতে পারে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক সূত্রহীন রহস্যের সমাধান করেছেন। সুতরাং যে পণ্ডিতেরা মোবাইল ফোন পোড়ানোর মতন কাণ্ড ঘটালেন, তারা এই সভ্য সমাজে বসবাসের উপযুক্ত কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে।

আমি এ কথা বলছি নিজ দায়িত্ব থেকেই। আমার তরুণ ছেলেও খুন হয়েছে। নিখোঁজ হয়েছিল। তার সর্বশেষ লোকেশন জানিয়েছে তার মোবাইল ফোনটিই। আমি সাংবাদিকতা করি, আমার ছেলেও সাংবাদিকতা করতো, সাব-এডিটর ছিল ইংরেজি বিভাগের। ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন, ফাগুন রেজা নামেই চেনে তাকে সবাই।

আমি জানি মোবাইল ফোনের প্রয়োজনীয়তা। যা ওই মহাপন্ডিতেরা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি। জানি না, এনাদের দিয়ে এমন একটা নামী প্রতিষ্ঠান চলে কীভাবে। আরে মোবাইলে ছেলে-মেয়েরা নষ্ট হলে আমার ছেলেও হতো। ওকে তো আমি ক্লাস এইটে মোবাইল দিয়েছি। কই নষ্ট হয়নি তো। বরং হয়েছিল সত্যনিষ্ঠ, আপোষহীন। অসৎ না হওয়াতেই খুন হয়েছে সে।

এমন শিক্ষকদের বলি। শিক্ষক হতে গেলে শুধু বই নয়, পাঠ্যক্রমই নয়, পারিপার্শ্বিকতারও খোঁজ রাখতে হয়। শিক্ষক হওয়া খুব সহজ কাজ নয়। মোবাইল ফোনের জন্য নয়, পারিবারিক, সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশের কারণে বাচ্চারা বিপথে যায়। গড়ে উঠা কিশোর গ্যাংগুলোর দিকে তাকান।

একটু চোখ মেলে দেখুন, এরা কারা, এদের পারিবারিক পরিবেশ ও অবস্থান কী, তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনগুলো, তাহলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে কেন বাচ্চারা বেপথু হয়। কোন একটা ইলেকট্রনিক ডিভাইস একটা বাচ্চাকে খারাপ করতে পারে না। শুধুমাত্র একটা যন্ত্র একটা বাচ্চাকে বিগড়ে দেবে এটা যে বা যারা বিশ্বাস করেন তাদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ভাবার কিছু নেই, তাদের আলোচনার বাইরে রাখতে পারেন।

পুনশ্চ

হ্যাঁ, মিন্নি রিফাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু যারা প্রকাশ্যে হত্যা করলো, তাদের কেন আড়াল করা হচ্ছে, কেন মিন্নিকেই সামনে আনা হচ্ছে? বাচ্চারা নষ্ট হচ্ছে পরিবার, সমাজ আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারণে। কেন দোষ হচ্ছে একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইসের?

এই বিস্ময়বোধক প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে ফারাজী ব্রাদারদের ক্ষমতার উৎস জানতে হবে। ফোন যারা পোড়ালেন তাদের দুর্বলতা জানতে হবে। আর তা না হলে, এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে, আর উদোর পিন্ডি চাপবে বুদোর ঘাড়ে।

ফুটনোট

শেষে একটা ঘটনা বলি। গল্প নয় সত্যি। তখন কেবল কলেজ পেরিয়েছি। আমার এক বন্ধু ছিল; তখন থেকেই অ্যালকোহলিক। একবার জানতে চাইলাম, এই অভ্যাসটা হলো কোথা থেকে? জানালো, আব্বার বেডরুমের ছোট ফ্রিজে বোতল থাকতো সবসময়। তা থেকেই অভ্যাস।

মজার ব্যাপার হলো, আমার ওই বন্ধুটিও যে পান করা শুরু করেছে, এটা জানতে পেরে তার মা রাগ করে ফ্রিজটিকে ভেঙে ফেলেছিলেন। লাভের মধ্যে হয়েছিল, ছোট ফ্রিজের পরিবর্তে শোবার ঘরে লাল রঙের আরেকটা বড় ফ্রিজের স্থান হয়েছিল!!

লেখক: কাকন রেজা, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

যুগান্তর

Next Post

স্ত্রী হত্যার দায়ে রাজশাহী আদালত থেকে প্রাপ্ত সাজা পেল, স্বামীর ফাঁসি।

বৃহস্পতি জুলাই ১৮ , ২০১৯
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ স্ত্রী সুফিয়া খাতুন বুলবুলিকে জবাই করে হত্যায় স্বামীর ফাঁসির আদেশ দিয়েছে রাজশাহীর আদালত। আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে রাজশাহী মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারক ও.এইচ.এম ইলিয়াস হোসাইন এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলো আসামি। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হলেন, নগরীর বায়া কোলাবাড়ি এলাকার এলকারমুল হকের ছেলে […]

এই রকম আরও খবর

শিরোনাম

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links