শিক্ষক যখন মানুষ গড়ার কারিগর

একজন শিক্ষক শুধুই শিক্ষকই নন তিনি একজন প্রশিক্ষক ও বটে। শিক্ষক যখন শ্রেণি কক্ষে শিক্ষার্থীদের কোন বিষয় বুঝিয়ে দেন বা শিখিয়ে দেন তখন তিনি শিক্ষক; যখন সৃজনশীলতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম, নেতৃত্ব, কষ্টসহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিকমনষ্কতা ও পরমতসহিষ্ণুতা ইত্যাদি সহপাঠ্য ক্রমিক কার্যক্রম বিষয়গুলো নজর দারিতে রাখেন ও নিয়ন্ত্রণ করেন তখন ঐ শিক্ষকই একজন প্রশিক্ষক। শিক্ষকের কাজ হবে শিক্ষা নিয়ে গবেষনা করা, কিভাবে আলো ছড়িয়ে অন্ধকারের মানুষ গুলোকে আলোর পথে নেয়া যায় । তা না করে এক শ্রেণীর শিক্ষক তাদের অপকর্মের মাত্রা এতটাই অতিক্রম করে যে, তাতে সমস্ত শিক্ষক জাতি আজ প্রশ্নবিদ্ধ । অবৈধ ব্যবসা বানিজ্য থেকে শুরু করে চিটারি বাটপারি, নারী কেলেংকারী এমনকী পত্রিকার পাতায় ভুমিদস্যু হিসেবেও শিক্ষকের নাম পরিচয় প্রাত্যহিক ঘটনা।

আজ কোথায় সে শিক্ষক আর কোথায় সে ছাত্র। শিক্ষক যখন স্কুলে আসতেন বা আসার সময় হতো তখন অনেক দুর এগিয়ে গিয়ে বা স্কুল গেটে অপেক্ষা করতাম আমি আগে সালাম দিবো, সবার আগে কুসল বিনিময় করব। আর শিক্ষকরা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন তখন দুপাশের মানুষের সালাম নিতে নিতে এমন অবস্থা দেখছি শেষ পর্যন্ত শুধু মাথা নাড়িয়ে হু হু করতে করতে সম্মান এবং শ্রদ্ধায় স্নাত হয়ে এগিয়ে যেতেন । কি সেই মহান দিন গুলো। কিন্তু আজ কি ছাত্র আর কি শিক্ষক। শিক্ষকরা সব সময় আতংকে থাকেন; এই বুঝি কোন ছাত্র অপমান করল, এই বুঝি পাওনাদার টাকা চাইল বা সামনে, পাশে ছাত্ররা বিড়ি টানছে বা মোবাইলে উচ্চস্বরে গান বাজাচ্ছে। তাও আবার সেই গান  না, যেই গানকে আর যাই হোক সুস্থ বিনোদন বলা যায় না। ছাত্রদের সাথে ছাত্রীর, শিক্ষকদের সাথে ম্যাডামদের এমনকী শিক্ষকদের সাথে ছাত্রীদের শ্লীলতা হানি বা নানা অশ্লীল শ্রুতি হরহামেশায় কানে আসে। কোথায় গেল সেই শিক্ষক আর কোথায় গেলো সেই শিক্ষার্থী। খুব অল্প সময়েই হারিয়ে যাচ্ছে সেই সোনালি, সুশ্রী, পবিত্র ও মহান সেই বিদ্যাপীঠের দৃশ্য ।

আজ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, এরিস্টেটল, প্লেটো, সক্রেটিস যদি শিক্ষকদের আজকের এই দৈন্যদসা দেখতে পেতেন তাহলে কতই না কষ্ট পেতেন । শিক্ষা, জ্ঞান হলো আলোর মশাল, যা সৃষ্টিকর্তা সবার হাতে দেন না। যার হাতে দেন তার অনেক বড় দায়িত্ব। দুনিয়ার অন্ধকারের মানুষগুলোকে জ্ঞানের মশালের আলো দেখিয়ে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখানো। কেউ যেন তার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়। বিধাতা যাকে শিক্ষকতা পেশাই সম্মানিত করেন হাতে তুলে দিলেন জ্ঞানের আলোর মশাল আর বললেন অন্ধকারের মানুষগুলোকে আলোকিত করতে। কিন্তু এই পথ দেখনো মানুষগুলো যখন জাতিকে আলোকিত না করে নিজেই হারিয়ে যায় অন্ধকারের গহীন গহবরে, তখন সমাজের কোথায় থাকবে মানুষরূপের মানবতা।

 একটাবার ভেবে দেখুন তো- কাঁমার ভাল দা, বোটি, ছুরি ইত্যাদি বানাতে পারে তাই এগুলোর প্রয়োজন হলে মানুষ কাঁমারের কাছে যায় । ভাল গহনা বানাতে পারে বলে তারা স্বর্ণকার এবং গহনা বানাতে মানুষ স্বর্ণকারের কাছে যায়। ভাল গাড়ি চালাতে পারে যারা তারা ড্রাইভার । যে যে বিষয়ে দক্ষ সে সে পেষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর বহন করে । মানুষ ড্রাইভিং শিখতে কখনও কাঁমারে কাছে বা অলংকার বানাতে কেহ ড্রাইভারের কাছে যায় না। যিনি যে বিষয়ে দক্ষ মানুষ সেই প্রয়োজনে তাঁর কাছেই যায় ।

তাহলে শিক্ষকরা কি ধোয়া তুলসী পাতা? সমাজ সেটা কখনোই বলে না। খবরে বর্তমান শিক্ষকদের কিছু কিছু ঘটনা আসে। পরীক্ষার পূর্বে ছাত্রের খাতায় শিক্ষকদেরই উত্তর লিখে দেওয়া, মিড ডে মিলের হিসাবের গড়মিল, শ্লীলতাহানি, উদ্দাম নৃত্য ইত্যাদি ইত্যাদি। সমাজের এ দৃশ্য বা ঘটনাগুলি ভালো লাগেনা বলে সমালোচনা(সমালোচনা ইতিবাচক ও নেতিবাচক সব দিকগুলো নিয়ে আলোচিত হয় না, হয় নিন্দা। সমগ্র শিক্ষক সমাজ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে পড়ে। শিক্ষক মহলও এ নিয়ে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়। কেউ বলে- বেশ করেছে। কেউ বলে- এটা ঠিক না। কেউ বলে- না ঠিক আছে, কিন্তু আরেকটু শালীনতা থাকলে ভাল হত। ভদ্রতা, শালীনতা বিষয়টি আপেক্ষিক। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়। উদাহরণ দেওয়া যাক। কোন শহুরে বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ইউনিফর্ম গ্রাম বাংলা কোন স্থানীয় ভাষার বিদ্যালয়ে প্রচলন হলে, গেল গেল রব উঠে যাবে। শ্লীলতা, শালীনতা নিয়ে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। সেরকম শিক্ষকদের পোশাক নিয়ে নানান মতবিরোধ। কেউ বলে ধুতি পাঞ্জাবি, কেউ বলে সাধারণ প্যান্ট-শার্ট, কেউ বলে শাড়ী। অন্যরা সালোয়ার কামিজে আস্থা রাখেন। জনসমাজ থেকেও কখনো কখনো মন্তব্য আসে- এখন আর ধুতি-পাঞ্জাবি পরা শিক্ষক নেই বিদ্যালয়ে আর সেরকম পড়ানো হয় না।

যেহেতু যারা শিক্ষক তাদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। ভাল মানুষ না হলে তো তিনি ভাল কারিগর হতে পারে না। নিশ্চয় যিনি ভাল মানুষ গড়ার কারিগর তিনি অত্যন্ত ভাল মানুষ, না হলে কি করে ভাল মানুষ গড়বেন lযদি তাই হয় তাহলে বিভিন্ন পন্য যেমন: খাদ্য, ঔষধ, ইত্যাদির ভেজালের সাথে মানুষ গড়ার কাজেও ভেজাল ঢুকে গেছে । মানুষ বাড়ছে কিন্তু ভাল মানুষ বাড়ছে না। খারাপ মানুষের সংখ্যা যদি এভাবে চক্রাবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে তাহলে ভাল মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাবে। নিম গাছ থেকে তিতা পাওয়া যাবে সুতরাং মিঠা পাওয়া কোন ভাবে কী সম্ভব ! খারাপ মানুষ খারাপ প্রডাকশন দিবে । আর ধীরে ধীরে ভালো বিলুপ্ত হবে। কারিগর যদি নষ্ট মানুষ হয় তাহলে তার গড়া মানুষ  তো নষ্ট হবেই । ছোট থেকে শুরু করে সকল প্রতিষ্ঠানে নষ্ট মানুষ তৈরি হচ্ছে । নষ্ট হওয়া আর পঁচে যাওয়া এক কথা নয় । ধরুন আপনার একুটা ইলেক্ট্রোনিক্স যন্ত্র বা  গাড়ীর একটা যন্ত্র বা যে কোন একটি পণ্য নষ্ট হয়েছে । যা রিপিয়ারিং সম্ভব। এবার ধরুন একটা পিয়ারা বা আপেল পঁচে গেছে ,এইটা যদি অন্য ভাল ফলগুলো থেকে আলাদা না করেন তাহলে সব ফল নষ্ট করে ফেলবে ওই পঁচা ফলটা । তখন ঐ পঁচা ফলটা বরং মাটির নিচে পুতে ফেলায় উত্তম। সমাজে দিন দিন ভাল মানুষের তালিকা একেবারে ছোট হয়ে যাচ্ছে । আর পঁচা বা নষ্ট মানুষের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে । ঐ যে একটার সংস্পর্সে অন্য গুলোও পঁচে যাচ্ছে। সমাজটা আজ মনে হচ্ছে পঁচে যাচ্ছে, দুরগন্ধ ছড়াচ্ছে ।

দেশ ধ্বংস করতে যুদ্ধের প্রয়োজন হয়না যদি শিক্ষাকে নষ্ট করা যায় তাহলে দেশ এমনিতেই শেষ হয়ে যায়। উপযুক্ত মুল্য দিয়ে অর্জিত কিছুর সাথে যে সুখানুভূতি তাহাই সাফল্য । আমাদের সেটাই অর্জন করা উচিৎ। অযথা সাফল্যের জন্য দশ দিকে না ছুটে আমরা যদি আমাদের নিজ পেশার প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা, কঠোর পরিশ্রম সঠিক উপস্থাপন আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করি তাহলে মনে হয় নতুন সূর্যের সন্ধান পাওয়া সম্ভব।

তবে এ কথাও ভুললে চলবে না, সমাজের প্রতিটি বিন্দুতে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে যারা বসে আছেন, তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভূমিকাকে। ভোলা যাবে না বা অস্বীকার করা যাবে না শিক্ষক, রিক্সাওয়ালা, অটোচালক, সরকারি কর্মচারী, কৃষক, ব্যবসাসহ শ্রমজীবী শ্রমিক শ্রেণী‌। ছাত্র/শিক্ষক/অভিভাবক সমাজ সম্পর্কের প্রবহমান স্বাভাবিক স্রোত কোন কারণে বাধাপ্রাপ্ত হলে শুধু শিক্ষক নয়, শুধু ছাত্র-ছাত্রী নয়, সমগ্র সমাজের ছড়িয়ে থাকা সমস্ত শ্রেনীর উপরে তার ফলাফল ছড়িয়ে পড়বে। তারই সূচনালগ্নে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে আছি বলার থেকেও আরো সত্য প্রবহমান স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কে বাধা দিচ্ছে তাও দেখার চোখ সবার থাকেনা। চক্ষুদান করতে হয়। সেই কাজটাও একজন শিক্ষকই পারেন।

মনে আছে সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে’র সেই শিক্ষক উদয়ন পন্ডিতের কথা। সমাজকে শিক্ষিত করার ফলাফল তিনি রাজার কাছ থেকে পেলেন ঠিকই। কিন্তু রাজার পরিণতির কথাও আমরা ভুলিনি।

শেষ কথা, তবুও শেষ নয়-গোটা সমাজে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত শ্রেণীর  মানুষের কাছে অনুরোধ- সুসম্পর্কের ধারাবাহিক স্রোতে বাধা প্রদানকারী শক্তিকে সনাক্ত করুন। সজাগ হোন। তাছাড়া সমাজ আগামীতে স্রোত হীন বালুচর মরুভূমি হতে বেশি সময় নেবে না।

লেখকঃ মোঃ তাজরুল ইসলাম

অধ্যক্ষ

কেশরহাট মহিলা কলেজ

Next Post

আরডিএ'র দূর্নীতি চরমে, রাজস্ব বঞ্চিত সরকার

রবি নভে. ২৭ , ২০২২
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ নানা অনিয়ম আর দূর্নীতিতে ১৩ বছর থেকে সরকারের প্রায় ২২ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি সাধন করেছে রাজশাহী উন্নয়ন  কর্তৃপক্ষ  (আরডিএ)। সরকারের রাজস্ব  ক্ষতি সাধন করে দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা মালিক হয়েছেন কোটি কোটি টাকার। সরকারের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ ও কিছু ঠিকাদার এমনই অভিযোগ উঠেছে আরডিএ কর্তৃপক্ষের কিছু অসাধু […]

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links