রোহিঙ্গা সংকটের ‘আসল সত্য’ প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রকাশিত নতুন একটি বইয়ে বিষয়টি নিয়ে চরম মিথ্যাচার করা হয়েছে।

আভা ডেস্ক : রোহিঙ্গা সংকটের ‘আসল সত্য’ প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রকাশিত নতুন একটি বইয়ে বিষয়টি নিয়ে চরম মিথ্যাচার করা হয়েছে। বইটিতে ব্যবহৃত একাধিক ছবি ও তথ্য বার্তা সংস্থা রয়টার্সের অনুসন্ধানে ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে।

এতে পুরনো সাদাকালো একটি ঝাপসা ছবি প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে এক লোক কৃষিকাজে ব্যবহৃত নিড়ানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুই লাশের পাশে। ক্যাপশনে বলা হয়েছে- ‘স্থানীয়দের নির্মমভাবে হত্যা করেছে বাঙালিরা’।

ছবিটি প্রকাশ করা হয়েছে ওই বইয়ে ১৯৪০-এর দশকে মিয়ানমারের দাঙ্গার অধ্যায়ে। ছবির বিবরণে বর্মি ভাষায় বোঝানো হয়েছে- রোহিঙ্গাদের হাতে বৌদ্ধ হত্যার ছবি। বইটিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনের মুসলিম রোহিঙ্গাদের বর্ণনা করেছে ‘বাঙালি অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে।

কিন্তু অনুসন্ধানে রয়টার্স দেখেছে, ওই ছবি আসলে তোলা হয়েছিল ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, যখন লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। হত্যাযজ্ঞের পর দুই বাংলাদেশির লাশ উদ্ধারের ছবি ছিল তা। যেটি তুলেছিলেন আনোয়ার হোসেন। অথচ ওই ছবি ব্যবহার করেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বইয়ে ক্যাপশনে বলা হয়েছে- সেটা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের হাতে নিহত স্থানীয় বৌদ্ধদের ছবি।

গত জুলাইয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ‘ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক রিলেশনস অ্যান্ড সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’ থেকে প্রকাশিত ওই বইয়ে এরকম তিনটি ভুয়া ছবি পাওয়া গেছে যেগুলো রাখাইন অঞ্চলের আর্কাইভ ছবি বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু রয়টার্সের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওই তিনটি ছবির মধ্যে দুটি তোলা হয়েছে বাংলাদেশ ও তানজানিয়ায়। মিয়ানমার ছেড়ে পালাতে থাকা রোহিঙ্গাদের আরেকটি ছবির ক্যাপশনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা।

এসব ছবির বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জ হাতোই বা সেনাবাহিনীর মুখপাত্রের বক্তব্য রয়টার্স জানতে পারেনি। মিয়ানমারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব উ মায়ো মিন্ট মং মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছেন, ওই বই তিনি পড়ে দেখেননি।

আরেকটি ছবি, যেটি পুলিৎজার পুরস্কারের ওয়েবসাইটে রয়েছে। রুয়ান্ডায় সহিংসতার পর ১৯৯৬ সালে হুটু শরণার্থীদের দেশত্যাগের এই ছবিটি তুলেছেন পিটাসবার্গ পোস্ট-গেজেটের আলোকচিত্রী মার্থা রিয়াল। একই ছবি সাদা-কালোতে বদলে নিয়ে ছাপানো হয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বইয়ে, বলা হয়েছে ব্রিটিশ আমলে বাঙালিরা প্রবেশ করছে মিয়ানমারে।

‘মিয়ানমারের রাজনীতি ও সেনাবাহিনী : প্রথম পর্ব’ নামে ১১৭ পৃষ্ঠার ওই বইয়ে গত বছরের আগস্টের পর শুরু হওয়া সামরিক অভিযান নিয়ে সেনাবাহিনীর ভাষ্য তুলে ধরা হয়েছে। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর হিসাবে, সেনাবাহিনীর ওই অভিযানে পাইকারি হত্যা, ধর্ষণ আর জ্বালাও-পোড়াওর মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে।

বইটিতে প্রকাশিত বেশিরভাগ তথ্যের উৎস হিসেবে সেনাবাহিনীর ‘ট্রু নিউজ’ ইউনিটের কথা বলা হয়েছে। গত বছর সংকটের শুরু থেকেই ওই ইউনিট সেনা প্রেক্ষিত থেকে ঘটনাপ্রবাহের ‘সংবাদ’ দিয়ে আসছে ফেসবুকে। মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনের সব বইয়ের দোকানেই পাওয়া যাচ্ছে সেনাবাহিনী প্রকাশিত বইটি। শহরের অন্যতম বড় বইয়ের দোকান ইনবার একজন কর্মী জানান, তারা ৫০ কপির অর্ডার দিয়েছিলেন, সেগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। বইটি নতুন করে আনার কোনো পরিকল্পনা তাদের আপাতত নেই, কারণ খুব বেশি মানুষ ওই বই নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি।

আরেকটি ছবি গেটি ইমেজের। ২০১৫ সালে ইয়াঙ্গুনে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর জব্দ করা ওই নৌকায় দেশান্তরের চেষ্টায় থাকা রোহিঙ্গাদের দেখা যাচ্ছে। ছবিটি উল্টো করে সাদাকালোতে বদলে নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বইয়ে। সেখানে বলা হয়েছে সমুদ্রপথে বাঙালিদের মিয়ানমারে অনুপ্রবেশের ছবি।

গত সোমবার জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘গণহত্যার অভিপ্রায়’ থেকেই রাখাইনের অভিযানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ কয়েকজনক জেনারেলকে বিচারের মুখোমুখি করতে বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

একই দিনে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানায়, বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধানসহ শীর্ষ জেনারেলদের ১৮টি অ্যাকাউন্ট ও ৫২টি পৃষ্ঠা তারা বন্ধ করে দিয়েছে।

‘মিয়ানমারের রাজনীতি ও সেনাবাহিনী : প্রথম পর্ব’ বইয়ে রাখাইনের অভিযানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হয়েছে, বর্তমান সংকটের সৃষ্টি হয়েছে ‘বাঙালি সন্ত্রাসীদের’ কারণে, তাদের উদ্দেশ্য ‘আরকিস্তান’ নামে রোহিঙ্গা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। গত বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কয়েক ডজন নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার জবাবে সেনাবাহিনী ওই নির্মম দমন অভিযান শুরু করে।

জাতিসংঘ বলছে, সেনাবাহিনীর ওই অভিযানে এ পর্যন্ত দশ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। মিয়ানমার সেনাদের বইয়ে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস খোঁজারও একটি চেষ্টা করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা নিজেদের রাখাইনের স্থানীয় বাসিন্দা বলে দাবি করে এলেও ওই বইয়ে তাদের দেখানো হয়েছে বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী হিসেবে।

বইয়ের মুখবন্ধে লেফটেন্যান্ট কর্নেল চিয়াও চিয়াও ও লিখেছেন, রাখাইনে ‘বাঙালিদের ইতিহাস প্রকাশ্যে আনতেই’ তারা ‘প্রামাণ্য ছবিসহ’ এই সংকলনটি করা হয়েছে। দেখা গেছে, যখনই মিয়ানমারে কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে বা কোনো ধরনের জাতিগত সহিংসতা হয়েছে, ওই বাঙালিরা ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছে। ওই বইয়ে ভুয়া ছবি ব্যবহারের বিষয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল চিয়াও চিয়াও ও’র বক্তব্য রয়টার্স জানতে পারেনি।
যুগান্তনের

Next Post

রাষ্ট্র এখন গণতন্ত্র-সুশাসন-নিরাপত্তা প্রশ্নে ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে সংকটাপন্ন।

শনি সেপ্টে. ১ , ২০১৮
Ava desk : জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, আমি বিশ্বাস করি, শেখ হাসিনা নিজেই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করবেন। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য দলীয় সরকার নয়- নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে তিনিই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে […]

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links