আভা ডেস্ক : গণহত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও গণধর্ষণ চালিয়েছে বলে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এই ভয়াবহ অপরাধের দায়ে দেশটির সেনাপ্রধান ও আরও পাঁচ জেনারেলকে আন্তর্জাতিক আইনের অধীন বিচারের মুখোমুখি করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযানে গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রকাশ্য আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের এটিই প্রথম কোনো প্রতিবেদন। এতে দেশটির বিচ্ছিন্নতা আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
এতে মিয়ানমারের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও কর্মকর্তাদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের তদন্তকারীরা।
প্রতিবেদনে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সন্দেহভাজন কর্মকর্তাদের বিচার করতে একটি অস্থায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠনেরও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এতে বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় নিজের নৈতিক কর্তৃত্ব ব্যবহারে ব্যর্থ হওয়ায় মিয়ানমারের নেত্রী শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চিকেও দায়ী করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচার উসকে দিয়ে, গুরুত্বপূর্ণ আলামত ধ্বংস এবং সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে সু চির সরকার। এর মাধ্যমে তার সরকারও নৃশংস অপরাধ সংঘটনে ভূমিকা রেখেছে।
২০ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাখাইনে গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে যথাযোগ্য আদালতে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার মতো যথেষ্ট তথ্য তদন্তকারীরা পেয়েছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, জাতিসংঘের কাজের পদ্ধতি অনুযায়ী ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার আগে এর একটি অনুলিপি মিয়ানমার সরকারকে দিয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য তারা করেনি।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল তুন তুন নাইকে ফোন করা হলেও তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়।
ইন্দোনেশিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মারজুকি দারুসমানের নেতৃত্বে গঠিত এ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের পাশাপাশি পাঁচজন জেনারেলের নাম উল্লেখ করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে বলা হয়েছে।
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলেনে তিনি বলেন, আমরা যে তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি, তা অত্যন্ত ভয়াবহ। ঘটনাকে প্রতিষ্ঠিত করাই হবে পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ।
এর মধ্যে মিয়ানমারের ৩৩ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অং অংয়ের নামও রয়েছে, যার বাহিনী উপকূলীয় ইন দিন এলাকায় অভিযানের দায়িত্বে রয়েছে। ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়ার ঘটনাটি ওই এলাকাতেই ঘটেছিল।
অন্যা জেনারেলরা হলেন, সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ভাইস সিনিয়র জেনারেল সো উইন, ব্যুরো অব স্পেশাল অপারেশনস ৩-এর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল অং কিয়াও জ, পশ্চিমাঞ্চলীয় মিলিটারি কমান্ডের প্রধান মেজর জেনারেল মং মং সো এবং ৯৯তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থান ও।
রয়টার্সের দুই সাংবাদিক ইন দিনের ওই ঘটনা বিশ্বের সামনে তুলে ধরার পর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ১০ বেসামরিক নাগরিককে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল।
সাত সৈনিককে ওই অপরাধে যুক্ত থাকার দায়ে ১০ বছর করে সাজাও দেয়া হয়েছিল।
রয়টার্সের ওই দুই সাংবাদিককেও এখন রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চি রাখাইনের ঘটনাপ্রবাহ বন্ধে সরকারপ্রধান হিসেবে তার কর্তৃত্ব বা নৈতিক বিবেচনা- কোনোটিই কাজে লাগাননি; নাগরিকদের রক্ষার যে দায়িত্ব তার ওপর রয়েছে, তা পালনের জন্য বিকল্প কোনো পথও তিনি খুঁজে বের করেননি।
রয়টার্স বলেছে, এ বিষয়ে সু চির মুখপাত্র জ তাইয়ের কোনো বক্তব্য তারা জানতে পারেননি।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন বলছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের অপরাধের জন্য পূর্ণ দায়মুক্তি পেয়ে আসছে, কখনই তাদের বিচারের জবাবদিহি করতে হয়নি। কোনো একটি অভিযোগ উঠলেই তা অস্বীকার করা, খারিজ করে দেয়া এবং তদন্তের পথ বন্ধ করে দেয়া হল তাদের সাধারণ নিয়ম।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকৃত নিরাপত্তা হুমকির তুলনায় সেনাবাহিনীর পদক্ষেপ ব্যাপক বৈষম্যমূলক।
রয়টার্স লিখেছে, গত বছর গঠিত জাতিসংঘের এই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সদস্যরা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা ৮৭৫ রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিয়ে, নথিপত্র, ভিডিও, ছবি এবং স্যাটেলাইট ইমেজ পর্যালোচনা করে ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
রুয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালে আট লাখ মানুষকে হত্যার ঘটনায় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কর্নেল থিওনেস্টে বাগোসোরাকে ২০০৮ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন জাতিসংঘ গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। পরে আপিলে তার সাজা কমিয়ে ৩৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
১৯৯৫ সালে বসনিয়ার সেব্রেনিকা শহরে গণহত্যার জন্য হেগের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল সার্ব নেতা রদোভান কারাদিচকে ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেয়। যুগান্তর