যত নারী জান্নাতে যাবেন, সবার নেত্রী ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহা।

মাওলানা একেএম মাহবুবুর রহমানঃ যে নুরের আকর্ষণে সারা জাহান মাতওয়ারা, যে নুরের আলোতে আলোকিত আশি হাজার মাখলুক, সিরাজাম মুনীরা হিসেবে যে নুর উদ্ভাসিত, সে নুরের সরাসরি অংশ হজরত ফাতেমাতুয যাহরা বাতুল রাদিআল্লাহু আনহা। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশ ধারার কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। যত নারী জান্নাতে যাবেন, সবার নেত্রী ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহা।

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোষণা, ‘ফাতেমাতু সাইয়্যেদাতু নিসাই আহলিল জান্নাহ’ ফাতেমা জান্নাতবাসী নারীদের নেত্রী হবেন। হাশরের ময়দানে যখন সব নবী রাসূল, সাহাবা, তাবেয়িন ও আওলিয়ারাসহ সব মানুষ সমবেত হবেন, ঘোষণা আসবে, ‘ইয়া আহলাল মাহশার, গুদ্দু আবসারাকুম ও নাককেসু রুউসাকুম হাত্তা তামুররা ফাতেমা’, হে হাশরের ময়দানে সমবেত জিন-ইনসান, সবাই চোখ বন্ধ করো, মাথা নত কর, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাশরের ময়দান অতিক্রম করা পর্যন্ত’।

এ হাদিস মোতাবেক হজরত ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহা কত বড় মর্যাদাবান মহীয়সী, তা সহজেই জানা যায়। কারণ তিনি সাইয়্যেদুল মুরসালিনের অস্তিত্বের অংশ। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ফাতেমাতু বাদয়াতু মিন্নি’ ফাতেমা আমারই অংশ। তিনি ছিলেন শেরে খোদা আলী রাদিআল্লাহু আনহুর ‘স্ত্রী’, জান্নাতের যুবকদের নেতা হজরত ইমাম হাসান ও হোসাইন রাদিআল্লাহু আনহুমার ‘মা’। তাই তো বিশ্ব কবি আশেকে রাসূল ও আহলে বাইত প্রেমিক ড. ইকবাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন,

মারইয়াম আয এক নেসবত ঈসা আযীয/ আয ছে নেসবত হজরত যাহরা আযীয নুরে চশমে রাহমাতুললিল আলামিন/ আন ইমামে আউয়ালিন ও আখেরিন

মারইয়াম হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে সম্মানী। হজরত ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহা তিন কারণে সম্মানী। তিনি ছিলেন রাহমাতুললিল আলামিনের নয়নের মণি। তিনি ছিলেন সৃষ্টির প্রথম ও শেষ ইমামের কলিজার টুকরা, তিনি ছিলেন হোসাইনের মা।

দার নাওয়াযে জিন্দেগি সুয আয হোসাইন/ আহলে হক হুররিয়্যাত আমুয আয হোসাইন জীবনের বীণা বাজাও হোসাইনের আদর্শে/ হক পন্থীগণ স্বাধীনতার সবক নাও হোসাইন থেকে ফাতেমা ফতেমাই ছিলেন। ফাতেমা অর্থমুক্ত। সব পাপমুক্ত, দুনিয়ার লোভমুক্ত।

তিনি ছিলেন যাহরা বা প্রস্ফুটিত জান্নাতি ফুল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তার নাম যাহরা এ জন্য যে, সে লে আল্লাহা কানাত তাযাহারুলে নুজুমু লে আহলিল আরদে’ কেননা, তার মাধ্যমে আকাশবাসী আলোকিত হয়েছে। আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র সুশোভিত হয়েছে। আর তা ছিল তার দুনিয়া বিমুখতা, পরহেজগারি এবং ইবাদতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার ফল।

তিনি ছিলেন পূতপবিত্র। আল্লাহ নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, ‘ওয়া ইউ তাহহিরাকুম তাতহিরা’ তোমাদের আল্লাহ পূতপবিত্র করতে চান। এ পবিত্র হওয়ার ঘোষণার আওতাভুক্ত ছিলেন হজরত ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহা। সমগ্র পৃথিবীতে সব নারী সৃষ্টিগত কারণেই কিছু সময় অপবিত্র ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। কিন্তু একমাত্র, কেবল ও শুধু হজরত ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহাই কোনোদিন অপবিত্র হননি।

মাসিক অপবিত্রতা ছাড়াই আল্লাহ তাকে পবিত্র সন্তান হাসান, হোসাইন ও যয়নব রাদিআল্লাহু আনহাকে দান করেছেন। তিনি ছিলেন বাতুল বা সম্পূর্ণ আলাদা। ফাতেমা যাহরা রাদিআল্লাহু আনহার তাসবিহ, দোয়া, নামাজ আদায়, আখেরাতের প্রতি তার আগ্রহ, দুনিয়ার সব মোহমুক্ত হওয়া, সব নারী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

তিনি ছিলেন সিদ্দিকা। যিনি জীবনে মিথ্যা বলেননি। তার আদর্শের পথে চলতে গেলে বিশ্বের কোনো নারী-পুরুষ কোনো দিন মিথ্যা বলা, মিথ্যার আশ্রয় নেয়া সম্ভব নয়।

তিনি ছিলেন ‘আল মুবারাকা’ বা বরকতের আধার। তিনি ছিলেন আল মারদিয়া। আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েই পরকালে শাফায়াতের অধিকার দেবেন।

তিনি ছিলেন ‘আয যাকিয়া’ বা কলুষমুক্ত। সমগ্র বিশ্বের নারী জগতে পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত মহীয়সী। তিনি ছিলেন উম্মুল আইম্মাহ বা ইমামগণের মা। তার বংশধারায় এ পৃথিবীতে এসেছে শতশত ইমাম।

তিনি ছিলেন ‘বীরঙ্গনা’। মক্কার কাফের গোষ্ঠী নামাজে-সিজদারত অবস্থায় উটের নাড়িভুঁড়ি এনে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহির ওয়া সাল্লামের ঘাড়ে রেখে দিল, ৩০-৪০ কেজি ওজনের চাপে যখন প্রিয়নবী (সা.)-এর নাভিশ্বাস উঠল। তখন হজরত ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহা কিশোরী হয়েও সাহসিকতার সঙ্গে সে নাড়িভুঁড়ি সরিয়ে দিয়েছেন। এই তো সেই ফাতেমা, যিনি ওহুদ ময়দানে পাহাড়ের পাদদেশে যখন কাফেরদের প্রচণ্ড আক্রমণে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রক্তাক্ত। তখন তারই সহযোদ্ধা রক্ত বন্ধ করার জন্য খেজুরের চাটাই পুড়িয়ে তার ছাই দিয়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গায়ে প্রলেপ দিয়েছিলেন।

তিনি ছিলেন মানবদরদি আদর্শ নারী। হজরত ইমাম হাসান ও হোসাইন রাদিআল্লাহু আনহুমার শৈশবে খুব জ্বর হল। কোনো ওষুধে জ্বর কমছে না। অবস্থা বেগতিক দেখে হজরত আলী রাদিআল্লাহু ও ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহা তিনটি নফল রোজার নিয়ত করেছেন। বিভিন্ন ব্যস্ততায় মান্নতের রোজা পালন করতে দেরি হয়ে গেল। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, রোজা রাখবেন। কিন্তু ঘরে সাহরি খাওয়ার কিছুই ছিল না। সামান্য কিছু খেয়ে রোজা রাখলেন।

হজরত আলী রাদিআল্লাহু আনহু সারা দিন খেটে মাত্র কয়েকটি রুটি তৈরি করার যব পেলেন। ইফতারের আগে রুটি তৈরি হল। হজরত হাসান ও হোসাইনকে দুটি দিয়ে দু’জনে দুটি রুটি নিয়ে ইফতারের জন্য বসলেন, এমন সময় এক মিসকিন এসে করুণ স্বরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ঘরে কে আছে গো, আমি কয়েকদিন খাওয়া পাইনি। ক্ষুধার জ্বালায় আমার জীবন যাচ্ছে। থাকলে কিছু দিন? হজরত আলী কিছুই বললেন না, কারণ ফাতেমা তো না খেয়ে রোজা রেখেছে।

হজরত ফাতেমা হজরত আলীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, আপনি যদি রাজি হন, তা হলে এ অসহায় মিসকিনটাকে রুটি দুটি দিয়ে আমরা সবর করি। আল্লাহতায়ালা কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘ওয়া আম্মাস সায়িলা ফালা তানহার’ কেউ চাইলে তাকে ফিরিয়ে দিও না। হজরত আলী রাদিআল্লাহু আনহু হজরত ফাতেমা যাহরা রাদিআল্লাহু আনহার মানবপ্রেম দেখে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করে রুটি দুটি মিসকিনের হাতে তুলে দিলেন।

দ্বিতীয় দিনে সামান্য কিছু খেয়ে রোজা রাখলেন। এ দিনে সামান্য কিছু গম জোগাড় করে রুটি তৈরি করে ইফতার করতে বসলেন, এমন সময় এক এতিম অসহায় এসে কেঁদে বলল, আমি কয়েকদিন খাইনি, যদি থাকে কিছু দিন। উপোবাস থেকে রোজা রেখে সারা দিন খেটে ইফতার করতে বসে এ ধরনের অবস্থায় পড়লে আমরা কী করতাম? আহলে বাইতে রাসূলের চরিত্র ও ধৈর্য ছিল উম্মতের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।

হজরত ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহা বললেন, আল্লাহর ওয়াস্তে চেয়েছে আমরা ধৈর্য ধরি, রুটি তাকে দিয়ে দিন। হজরত আলী রাদিআল্লাহু আনহু রুটি দুটি তাকে দিয়ে দিলেন। তৃতীয় দিনও সামান্য কিছু খেয়ে রোজা রাখলেন। তিন দিনের উপোস থাকার পর হজরত আলী আর চলতে পারছেন না। তার পরও অনেক কষ্টে কিছু যব পেলেন। রুটি তৈরি হল। তিন দিন পর ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় ইফতার করতে বসেছেন, এমন সময় একজন কয়েদি না খেয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

ঘরের দরজায় এসে করুণ সুরে বলল, আমি কয়েদি ছিলাম, মাটির নিচের গর্তে আমাকে বহু দিন রেখে দেয়া হয়েছে। খাওয়া দেয়া হয়নি। ক্ষুধায় আমার জীবন যাচ্ছে। আমাকে খাওয়া দিন। হজরত ফাতেমা যাহরা রাদিআল্লাহু আনহা হজরত আলী রাদিআল্লাহু আনহুকে বললেন, এ ক্ষুধার্থ ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দেয়া যায় না। এই বলে রুটিগুলো কয়েদিকে দিয়ে দিলেন। লাগাতার তিন দিন না খেয়ে রোজা শেষ করলেন। আল্লাহতায়ালা রাতেই আয়াত নাজিল করলেন, ‘আল্লাহর মুহাব্বতে যারা মিসকিন, এতিম ও কয়েদিদের খাবার দেয়, আর বলে আমরা এ খাওয়া শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য খাওয়াই, তাতে কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ চাই না। নিশ্চয়ই আমরা আমাদের রবকে ভয় করি। সেদিন ভয়ংকর ও কষ্টকর (সূরা আদ দাহার, আয়াত ৮-১০)।

তিনি ছিলেন নারী জাতির ইমান, আমল, শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানবতার আদর্শ। তার পরিবারের ওপর এ জন্যই প্রতি নামাজে দরূদ পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একজন আদর্শ মা হতে হলে, হজরত ফাতেমা যাহরা রাদিআল্লাহু আনহাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। কারণ একজন আদর্শ মা-ই পারে আদর্শ জাতি উপহার দিতে।

তাই তো ড. ইকবাল বলেছেন, ‘সিরাতে ফরজন্দহা আয উম্মাহাত+জওহারে সিদক ও ছাফা আয উম্মাহাত’। সন্তানের চরিত্র হয় মায়ের ছায়া, সত্য ও সততার বীজ তৈরি হয় মায়ের কোলে। শেখ সা’দী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাই তো দোয়া করেছিলেন, ‘এলাহি বেহাক্কে বনি ফাতেমা, কেহ বর কওলে ইমান কুনাম খাতেমা’ ফাতেমার বংশের উসিলায় এলাহি ইমানি মৃত্যু যেন হয় শেষ পরিণতি। আল্লাহ আমাদের এ মহান মহীয়সীর পথ অনুসরণ করার তাওফিক দিন।

লেখক : প্রান্ধিক

Next Post

স্ত্রীর যৌতুক ও নির্যাতনের মামলায় এ এস আই কারাগারে ।

শুক্র ফেব্রু. ২৮ , ২০২০
আভা ডেস্কঃ যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের অভিযোগে স্ত্রীর দায়ের করা মামলায় পুলিশের এএসআইকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার বরিশালের নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে জামিনের আবেদন করলে এএসআই ইশা খানকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। ইশা খান পটুয়াখালীর মোহাকাঠি গ্রামের ইয়াসিন খানের ছেলে। তিনি ভোলা পুলিশ লাইনে দায়িত্ব পালন করছিলেন। মামলার এজাহারে […]

এই রকম আরও খবর

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links