আভা ডেস্কঃ বাজেটে জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, বর্তমানে বাজেট ছকবাঁধা হয়ে গেছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব ছাড়া কিছুই থাকে না। জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যায় না। বাজেট ঘোষণার পর আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংশোধিত হয়।
এ অবস্থায় কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া কল্যাণমুখী বাজেট প্রণয়ন সম্ভব নয়। জাতীয় প্রেস ক্লাবে শুক্রবার সুজন আয়োজিত ‘বাজেট ২০১৯-২০২০ ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনরা এ কথা বলেন।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় বৈঠকে বক্তব্য দেন সংস্থার সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনু ম–হাম্মদ, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর।
মূল প্রবন্ধে ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বাজেট ব্যবস্থায় জবাবদিহিতার চর্চা নেই। বাজেট ঘোষিত হওয়ার পর আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংশোধিত হয়। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী সংশোধিত বাজেট সংসদে উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় আলোচনা ছাড়াই আইনে পরিণত হয়। কেন সংশোধনের প্রয়োজন হল বা কেন তা বাস্তবায়িত হল না, এ নিয়ে কোনো তর্কাতর্কি হয় না।
কণ্ঠভোটে বাজেট পাস করা ছাড়া সংসদ সদস্যদের কোনো ক্ষমতাও নেই। অর্থাৎ বাজেটের পুরো প্রক্রিয়াটিতে জবাবদিহিতা ও গণতান্ত্রিক চর্চার ঘাটতি রয়েছে। বর্তমান প্রক্রিয়ায় সংসদ সদস্যদের কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই। বাজেট ব্যবস্থার আমূল সংস্কার আশু প্রয়োজনীয়।
সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন বলেন, বাজেট আলোচনায় প্রান্তিক মানুষের সমস্যা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না। বাজেটে কৃষকের সমস্যা দেখা হয়নি। ধানের উৎপাদন মূল্য কমানোর জন্য ভর্তুকি দেয়ার দরকার ছিল, সে বিষয়ে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ বাজেটে নেয়া হয়নি। হলফনামার তথ্যানুযায়ী, অর্থমন্ত্রী দেশের শীর্ষ ধনীদের একজন। তিনি দরিদ্রদের জীবন নিয়ে কতটা ভাববেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বাজেটে সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা দরকার। মানুষের অবস্থা ও অবস্থানের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। দরিদ্র মানুষের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।
অথচ বাজেটে এর প্রতিফলন নেই। বর্তমানে বাজেট হয়ে গেছে অনেকটা ছকবাঁধা, তাই বাজেটের কাঠামোগত সংস্কার দরকার। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে।
এগুলোর অনেকই জিডিপি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখলেও রামপাল ও রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো অনেক প্রকল্প ভয়ানক। ভূমিকম্প হলে রূপপুর প্রকল্প আমাদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে। রূপপুর প্রকল্প থেকে যে বর্জ্য নির্গত হবে, তার কী ব্যবস্থা হবে, আমরা সে সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু জানি না।
বাজেটে জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে মন্তব্য করে অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, জুন-জুলাই অর্থবছর হওয়ায় নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। জুনে বর্ষাকাল শুরু হওয়ায় প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানসহ দু তিনটা দেশ ছাড়া কোথাও জুন-জুলাই অর্থবছর নেই। তাই এর পরিবর্তন করা দরকার।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি ‘ফাঁপা’ অবস্থায় রয়েছে মন্তব্য করে এ অধ্যাপক বলেন, বাজেটের আকার বৃদ্ধি কোনো চমক নয়। এটা মানুষের বয়স বাড়ার মতো, প্রতিবছর বাড়তেই থাকবে। বরং বিভিন্ন খাতে বাজেটে যে বরাদ্দ দেয়া হয়, পরিমাণ ও গুণগত মান ঠিক রেখে তা কতটা বাস্তবায়ন হয়, সে বিষয়ে আলোচনা হওয়া দরকার।
বর্তমানে খরচ দেখানোকে বাজেট বাস্তবায়ন মনে করা হয়। তাই বছরের শেষদিকে অর্থছাড়ের হিড়িক পড়ে। বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে সরকারের আগ্রহ দেখা যায়, অন্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে অর্থছাড়ের বিষয়ে আগ্রহ দেখা যায় না।
আনু মুহাম্মদ বলেন, বাজেটে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা বলা হয়েছে। এটা কৌতুককর বিষয়। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে দায়মুক্তি আইন করা আছে। ব্যাংক খাত থেকে দেড় লাখ কোটি টাকা হাওয়া হয়ে গেছে। সে বিষয়ে আলোচনা নেই। পুঁজিকে এককেন্দ্রিক করতে যা যা করা প্রয়োজন, সরকার তার সবই করছে। কালো টাকা হিসাব করলে ধনী-গরিবের আয়বৈষম্য আরও বাড়বে।
সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল বলেন, এই বাজেটের কিছু ভালো দিক ও মন্দ দিক রয়েছে। ভালো দিক হল বাজেটের আকার ও পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। বাজেট উচ্চাভিলাষী মনে হলেও উচ্চাভিলাষ থাকা ভালো। এই বাজেটের ৭০ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে পারলেও তা কম হবে না। মানবসম্পদ ও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষাও একটি ইতিবাচক দিক।
অন্যদিকে বিগত কয়েক বছরে কৃষিতে প্রবৃদ্ধি কমে এসেছে। দারিদ্র্য হ্রাস না পাওয়ার আরেকটি কারণ হল কর্মসংস্থান কাক্সিক্ষত মাত্রায় বৃদ্ধি না পাওয়া এবং আন্তঃবিভাগীয় বৈষম্য।
কিন্তু দেশের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য রোধে বাজেটে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সম্পূরক বাজেট নিয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা হওয়া দরকার। গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার, সহ-সম্পাদক জাকির হোসেন, বিআইডিএসের গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ প্রমুখ।
যুগান্তর