Ava Desk : সৎ ও অসৎ সরকারি চাকরিজীবীদের নিয়ে ‘কারাগারের রোজনামচা’য় স্মৃতিচারণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্থপতি জেলজীবনের রোজনামচায় লিখেছেন, ‘এক থানায় একজন কর্মচারী খুব সৎ ছিলেন। ঘুষ তিনি খেতেন না। কেহ ঘুষ নিক তিনি তাহাও চাইতেন না, সকলে তাকে বোকা বলতে শুরু করে- ছোট থেকে বড় পর্যন্ত।
একদিন তার এক সহকর্মী তাকে বলেছিল, সাধু হলে চাকরি থাকবে না। বড় সাহেবের কোটা তাকে না দিলে খতম করে দিবে। তিনি তাহা শুনলেন না। বললেন, ঘুষ আমি খাব না, আর ঘুষ দিবও না। সত্যই ভদ্রলোক ঘুষ খেতেন না। কিন্তু কিছুদিন পরে দেখা গেল ঘুষ খাওয়ার অপরাধে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এই মিথ্যা মামলায় তাকে চাকরি হারিয়ে কোর্টে আসামি হতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কোর্ট থেকে তিনি মুক্তি পান, চাকরি আর করেন নাই।’
এমন সৎ সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা এখন খুবই বিরল। বিপরীতে চারপাশে তাকালে আমরা নিশ্চয়ই অনুভব করি, বুঝি যে, যার কারণে সেই সৎ কর্মচারী চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, তারা সংখ্যায় অনেক বেশি। বেশি দেখেই তাদের পাল্লা ভারি। আর সেই ওজনে তারা সংঘবদ্ধভাবে পাল্টে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন সরকার ও রাষ্ট্রের নীতির? সংবিধানের ‘সকল নাগরিক সমান’ এই মূলনীতিকে তারা থোড়াই কেয়ার করেন। তা না হলে রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের জন্য এক আইন আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ভিন্ন আইন হবে কেন?
গত ২০ আগস্ট মন্ত্রিসভায় ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন হয়েছে। এর একটি ধারায় আছে, ফৌজদারি অপরাধে চার্জশিটের আগে কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতার করা যাবে না। প্রয়োজন হলে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। এ ধারাটি সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের বিরোধী। এতে আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’
শুধু সাধারণ নাগরিক নয়, প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক সৎ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর। সততায় যাদের সুনাম আছে, এমন দু’একজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের মতে, এতে দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হবে। কেউ যদি দুর্নীতি করেন, ঘুষ খান তাকে গ্রেফতারে কেন চার্জশিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? সৎ কর্মকর্তাদের তো গ্রেফতারে ভয় থাকার কথা নয়।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও ফরাসি গবেষক জঁ দ্রেজ তাদের যৌথ গবেষণা গ্রন্থ ‘ভারত : উন্নয়ন ও বঞ্চনা’য় লিখেছেন, ‘প্রশাসনের যে বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলোতে সরকারি কর্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আর্থিক প্রাপ্তিযোগ এবং বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বিনিময়ের অবকাশ আছে এবং ধরা পড়ার আশঙ্কা কম, সেখানে দুর্নীতির প্রকোপ বেশি।’ গ্রন্থের আরেক অংশে সেন ও দ্রেজ বলছেন, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের নাম প্রকাশ করে তাকে লজ্জায় ফেলার সম্ভাবনা থাকলে দুর্নীতির আশঙ্কা কমে।’
প্রস্তাবিত সরকারি চাকরি আইনে দুর্নীতিবাজদের ধরা পড়ার চেয়ে রক্ষার দিকটি প্রাধান্য পেয়েছে। অমর্ত্য সেনের কথা ধার করে বলা যায়, এতে দুর্নীতির প্রকোপও বাড়বে। আবার দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতাও এর মাধ্যমে খর্ব হবে। প্রস্তাবিত আইনে দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতারে অনুমোদনের বিষয়টি দুদক আইনের কয়েকটি ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দুদক আইন-২০০৪ অনুযায়ী দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান।
আইনের ২৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের বিধানাবলীর সাপেক্ষে, কমিশনারগণ এই আইনের অধীন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।’ আইনের এ ধারা অনুযায়ী কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি চাকরিজীবীকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্তে কোনো বাধা নেই দুদকের। কিন্তু প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী গ্রেফতারের আগে অনুমোদন নিতে হলে দুদকের সেই স্বাধীন সত্তা খর্ব হবে।
দুদক আইনের ২৮-এর ‘ক’ ধারা অনুযায়ী আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতারের ক্ষমতা আছে প্রতিষ্ঠানটির। আইনের ২০-এর ৩ উপধারায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মতো চাইলেই দুর্নীতিবাজদের ধরতে পারবে দুদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। প্রস্তাবিত সরকারি চাকরি আইন সংসদে পাস হলে দুদকের এসব ক্ষমতা খর্ব হবে। অন্যদিকে চার্জশিট দেয়ার পর দুর্নীতির মামলার ক্ষেত্রে আর এখতিয়ার থাকে না দুদকের। তা আদালতের হাতে চলে যায়। এ অবস্থায় চার্জশিটের পর অনুমোদন ছাড়া গ্রেফতারের ক্ষমতা পেয়েও লাভ নেই স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটির।
প্রস্তাবিত সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী ফাঁদ পেতে ঘুষখোর ধরতেও সংকটে পড়বে দুদক। এতে সেবা খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ফাঁদ মামলা অকার্যকর হলে ঘুষখোরদেরই পোয়াবারো। যদি চার্জশিটের আগে কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতারে অনুমতি লাগে, তাহলে ফাঁদ পেতে ঘুষখোরদের গ্রেফতার করা যাবে না। অনুমোদন নিতে হলে আগেই তথ্য ফাঁস হওয়ার পাশাপাশি আইনি জটিলতায় পড়বে দুদক।
কেউ যদি ঘুষের অভিযোগ নিয়ে আসে তাহলে দুদক বিধিমালা ২০০৭-এর পঞ্চম অধ্যায়ের ১৬(১) ও (২) অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। কমিশনের অনুমতি নিয়ে সেক্ষেত্রে একজন পরিচালকের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ফাঁদ পাতেন। এ ক্ষেত্রে গ্রেফতারের পর মামলা হয়। আর প্রস্তাবিত আইনে বলা হচ্ছে চার্জশিটের আগে গ্রেফতারই করা যাবে না, অনুমোদন লাগবে।
দুদকের এমন ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ ভবিষ্যতের কারণে নিশ্চয়ই আফসোস করছেন এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ফাঁদে পড়ে মানসম্মান খোয়ানো ষাটের বেশি ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। ৫-১০ লাখ টাকা ঘুষসহ হাতেনাতে গ্রেফতার হওয়া নৌপরিবহন অধিদফতরের সাবেক দুই প্রধান প্রকৌশলী হয়তো মাথা চাপড়াচ্ছেন- কেন আরও আগে অনুমোদন পেল না এমন ‘উপকারী’ আইন? হাতেনাতে ঘুষসহ আটক হয়ে মানসম্মান খুইয়ে, জেল খেটে মুখ দেখানো দায় হয়ে গিয়েছিল যাদের, তারা এখন এই আফসোস ও হতাশা কোথায় লুকাবেন?
তাদের নিশ্চয়ই আক্ষেপ, দীর্ঘদিন ঝুলতে থাকা ‘সরকারি চাকরি আইন’টি আরও আগে পাস হলে কী এমন ক্ষতি হতো! জানা যাচ্ছে, সেই ২০০৬ সালে ‘সিভিল সার্ভিস আইন’ নামে এর অঙ্কুরোদগম হয়েছিল। এরপর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনটির খসড়া করেছিল। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার কমিটি করে দিয়েছিল।
২০১৫ সালে মন্ত্রিসভা খসড়ার নীতিগত অনুমোদনও দিয়েছিল। অথচ সেই আইনই কিনা মন্ত্রিসভার চূড়ান্ত অনুমোদন পেল ২০১৮-এর আগস্টে এসে। আরও আগে খসড়া চূড়ান্ত করা গেলে এতদিনে নিশ্চয়ই আইনটি পাস হয়ে যেত সংসদে। আর তাহলে উপরের ভুক্তভোগী ঘুষখোর কর্তাদের ঝট করে ফাঁদ পেতে ধরতে পারত না দুদক। কারণ ধরতে গেলে অনুমোদন লাগত সরকারের।
প্রস্তাবিত ‘সরকারি চাকরি আইন’ চূড়ান্ত হওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের কাছে প্রশ্ন ছিল, ‘এই আইন পাস হলে দুদক ফাঁদ পেতে কোনো সরকারি কর্মচারীকে গ্রেফতার করতে পারবে কিনা? এর জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, ‘চার্জশিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। চার্জশিট হওয়ার আগে গ্রেফতার করতে হলে আগে অনুমতি নিতে হবে।’ তার মতে, ‘এতে দুদকের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে না। একটু বিলম্বিত হবে।’
এমনিতে দুর্নীতির মামলার বিচারে বিলম্বের শেষ নেই। দুদকের তথ্য অনুযায়ী ২০ বছর আগের দুর্নীতির বেশকিছু মামলা এখনও বিচারাধীন আছে। এ অবস্থায় নতুন আইন করে বিলম্বের মাত্রা আরও বাড়ানোর কারণ কী?
বর্তমান দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০১৬ সালের মার্চে। দায়িত্ব নিয়েই তিনি প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে নামেন। তার কার্যক্রমের প্রায় আড়াই বছরে দুর্নীতির মামলায় প্রায় সোয়া ছয়শ’ আসামি গ্রেফতার হয়েছে। ২০১৬ সালে ৩৮৮ জন, পরের বছর ১৮২ আর এ বছর এখন পর্যন্ত ৬০ জনের বেশি। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সরকারি প্রশাসন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল চারশ’র বেশি। সুষ্ঠু তদন্ত ও দলিল-দস্তাবেজ সংগ্রহের প্রয়োজনে মামলার পরপরই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, যাতে মু্ক্তু থেকে আসামি দালিলিক তথ্য-প্রমাণ, আলামত নষ্ট বা সরিয়ে ফেলতে না পারে।
এমন গ্রেফতার অভিযান নিশ্চয়ই শক্তিশালী আমলাতন্ত্র ভালোভাবে নেয়নি। মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় ছিল। জাতীয় নির্বাচন যখন দোরগোড়ায় তখন সুযোগ নিতে আর কসুর করেনি। অভিযোগের ভিত্তিতে ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফাঁদে ফেলে আটক করে থাকে দুদক। কিন্তু সেই দুদকই এখন শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের আইনি ফাঁদে।
এ অবস্থায় প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে সংশয় ও হতাশায় আছেন দুদকের আইন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষ এ ক্ষেত্রে দুদককে আশ্বস্ত করেছিল। আশ্বাস দিয়ে বলেছিল, ‘সরকারি চাকরি আইন’ ক্ষতির কারণ হবে না দুদকের জন্য। কিন্তু প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি পরে যে আট সদস্যের উপকমিটি গঠন করেছিল, তারা শেষ পর্যন্ত দুদকের ক্ষমতা খর্বের মতো প্রস্তাবই করেছে।
ফৌজদারি মামলায় অনেক সময় সরকারি কাজ বাধাগ্রস্ত হয়, আমলারা ঝুঁকির মুখে পড়েন। তাদের যেন হয়রানি না হয়, দ্রুত কাজ এগোয়- প্রস্তাবিত আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার মর্ম এমনই। কিন্তু এর ফাঁকফোকর গলে যদি দুর্নীতিবাজদের পার পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয় তাহলেই সর্বনাশ।
ড. আকবর আলি খান তার ‘অবাক বাংলাদেশ : বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ গ্রন্থে বলছেন, ‘প্রশাসনে খারাপ লোকেরা ভালো লোকদের কোনো আসন দেন না।’ সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব একে তুলনা করেছেন গ্রেশাম বিধির সঙ্গে। গ্রেশাম বিধির বক্তব্য হল, ‘একইসঙ্গে বাজারে ভালো ও মন্দ মুদ্রা থাকলে ভালো মুদ্রা লোকে ঘরে তুলে রাখে আর শুধু খারাপ মুদ্রা বাজারে চালু থাকে। অন্য কথায় খারাপ মুদ্রা ভালো মুদ্রাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।’ দেশের প্রশাসনে এমনটিই চলছে, খারাপ ভালোকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে দেদার।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগেও প্রায় একই ধরনের আইন পাসের উদ্যোগ নিয়ে সফল হয়েছিল আমলাতন্ত্র। সে সময় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলার আগে সরকারের অনুমোদন নেয়ার বিধান যুক্ত করেছিল। সংসদে আইনটি পাসও হয়েছিল। তবে পরে উচ্চ আদালতে খারিজ হয়ে গেছে। ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি উচ্চ আদালত সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন হিসেবে তা বাতিল করে দেন।
প্রস্তাবিত ‘সরকারি চাকরি আইন’টির ক্ষেত্রে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চেয়েছিলাম দুদক চেয়ারম্যানের কাছে। তিনি আইনি পদক্ষেপের পক্ষে নন। তার আশা, ‘সংসদে পাসের আগেই সাংঘর্ষিক ধারাটি বাতিল করা হবে।’ তিনি এও বলেছেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত না এটাকে (দুদক) পরাধীন সংস্থা করা হচ্ছে, ততদিন কিন্তু স্বাধীনই থাকবে এটা। এবং দুদক কোনো অনুমতি নিয়ে কাজ করবে না। গ্রেফতার অভিযানও চলবে।’
দুদক চেয়ারম্যানের আশাবাদ যেন ফলে। সাহসী কার্যক্রম যেন বন্ধ না হয়। মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের পর প্রস্তাবিত ‘সরকারি চাকরি আইন’টি যাচাই-বাছাই করবে সংসদীয় কমিটি। সংসদ সদস্যরা তাদের যৌক্তিক মত দেবেন।
প্রচলিত আইনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, এমপি বা মন্ত্রী যিনিই হোন, তাদের অনুমোদন ছাড়া গ্রেফতারের বিধান রয়েছে। অথচ প্রস্তাবিত চাকরি আইনে সরকারি চাকরিজীবীদের চার্জশিটের আগে গ্রেফতারে অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। আমলাদের ক্ষেত্রে এক আইন আর জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষেত্রে ভিন্ন আইন, এটি কেন হবে?
আইনটি সংসদে পাসের আগে এ নিয়ে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক সরকার ভেবে দেখবে। তা না হলে নাসিরউদ্দিন হোজ্জার মতো ধূর্ত চালে যেমন বাদশাহ ধরা খেয়েছিল, তেমনি আমলাতন্ত্রের ফাঁদে পড়তে হবে সরকারকেও।
হোজ্জার গল্পটি বলে এবার শেষ করা যাক। একদিন ঠাট্টার ছলে মোল্লা নাসিরুদ্দিন উজিরকে বললেন, ‘জানেন হুজুর, ভাগ্য গণনা করে দেখলাম আগামীকালই আপনার অপঘাতে মৃত্যু হবে!’ তখন কে জানত পরদিন ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে সত্যিই বৃদ্ধ উজির মারা যাবেন! এ ঘটনার কথা শেষ পর্যন্ত বাদশাহর কানে উঠল। মোল্লার অলুক্ষণে কথায় উজিরের জীবন গেছে শুনে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে পড়লেন। হুকুম দিলেন, ‘কে কোথায় আছিস, এক্ষুণি হতচ্ছাড়া মোল্লাকে বেঁধে নিয়ে আয়!’
যেই কথা সেই কাজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রহরীরা মোল্লাকে বেঁধে আনল। বাদশাহ বললেন, ‘নাসিরুদ্দিন, তুমি আমার প্রিয় উজিরকে শাপ দিয়ে মেরে ফেলেছ, তোমাকে কী শাস্তি দেব, সেটা তুমি নিজেই বলো!’
‘হুজুর, আপনিই যখন আমাকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছেন, তখন আপনিই সেটা ঠিক করুন!’
‘বহুত আচ্ছা, তুমি যখন অন্য লোকের মৃত্যুর সময় গণনা করে বার করতে পারো, তখন নিজের মৃত্যুর দিনক্ষণটা ঠিক করে বলো! কিন্তু হুশিয়ার, এ ব্যাপারে যদি তোমার জ্ঞান না থাকে আর উল্টো কিছু বলো, তাহলে আজই হবে তোমার জীবনের শেষদিন!’
‘জি হুজুর’, মোল্লা বাদশাকে কুর্নিশ করে বললেন, ‘আপনার মৃত্যুর ঠিক একদিন আগে আমার মৃত্যু হবে জাহাপনা। যাকে বলে চব্বিশ ঘণ্টা আগে-পরে।’
মোল্লার কথা শুনে বাদশাহ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেলেন। তিনি প্রহরীদের তখনই মোল্লাকে মুক্তির আদেশ দিলেন। তারপর তাদের ডেকে বললেন, ‘তোমরা সর্বক্ষণ ওকে পাহারা দিয়ে রাখবে, যাতে ও কোনোমতেই মারা না যায়।’
হোজ্জার কথার চালে বাদশাহ মহাশয় শুধু কুপোকাতই হননি, ভয়ে হোজ্জার সার্বিক নিরাপত্তাও দিতে হয়েছে। আমলাতন্ত্রের আইনি চালও একই রকম। যে সংসদ সদস্যরা প্রস্তাবিত ‘সরকারি চাকরি আইনি’ সংসদে পাস করবেন, তাদের গ্রেফতার করা যাবে অনুমোদন ছাড়া। আর যাদের জন্য সংসদে তারা ‘হ্যাঁ’ বলবেন, তারা এ ক্ষেত্রে পাবেন আইনের বাড়তি সুরক্ষা!