প্রত্যাবাসন প্রশ্নে মিয়ানমার সরকার ও জাতিসংঘের চুক্তি স্বাক্ষর।

আভা ডেস্ক: প্রত্যাবাসন প্রশ্নে মিয়ানমার সরকার ও জাতিসংঘের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি নিয়ে রোহিঙ্গাদের হতাশার কথা জানা গেছে আগেই। এবার ওই চুক্তির প্রক্রিয়া আর অস্পষ্টতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা সংগঠন। তাদের অভিযোগ, পূর্ণাঙ্গ চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। এ নিয়ে যতোটুকু যা জানা গেছে, তাতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রশ্নের কোনও মীমাংসা করা হয়নি। রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো অভিযোগ তুলেছে, মিয়ানমার সরকার ও জাতিসংঘের কর্মকর্তারা চুক্তি স্বাক্ষরের আগে কমিউনিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করেনি। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)’র সঙ্গে গত ৬ জুন সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে মিয়ানমার সরকার।

গত ৬ জুন (বুধবার) নেপিদোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ‘রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এই চুক্তিটিকে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন মিয়ানমারে নিয়োজিত জাতিসংঘের আবাসিক এবং মানবিক সহায়তাবিষয়ক সমন্বয়কারী নাট ওৎসবি। রবিবার (১০ জুন) প্রকাশিত এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো ওই চুক্তি নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।

মিয়ানমার সরকার সমঝোতা চুক্তি সম্পন্নের পর দাবি করে, এর মধ্য দিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। তবে মিয়ানমার সরকারের বিবৃতিতে রোহিঙ্গা শব্দটি উল্লেখ করা হয়নি। তাদের ‘বাস্তুচ্যুত মানুষ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ১০ জুন রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, চুক্তিতে রোহিঙ্গা সংকটের ‘মূল কারণ’-এর কথা উল্লেখ করা হয়নি; বিশেষ করে, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রশ্নটি সুরাহা করা হয়নি। বিবৃতিতে বলা হয়, প্রত্যাবাসনের জন্য শরণার্থীদের ‘নিরাপত্তা, মর্যাদা ও পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্ব ও অধিকারের’ ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো নিশ্চিত হলেই তারা রাখাইন রাজ্যে বসবাস করতে পারবে। কক্সবাজারের কুতুপালং শিবিরে বসবাসরত এক রোহিঙ্গা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিয়ানমার ফ্রন্টিয়ারকে চুক্তি নিয়ে নিজের অবস্থান জানান। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পূর্ববর্তী উদ্যোগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘লোকজন (রোহিঙ্গা) চিন্তায় আছে, অধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত না করেই যদি তারা ফিরে যায় তবে আগের মতো অবস্থা হবে।’

মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি ও মানবিক সহায়তাবিষয়ক সমন্বয়কারী নাট ওৎসবি ফ্রন্টিয়ারকে বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে যথাযথ পরিবেশ গড়ে তোলার কাজে সহায়তার জন্য ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপি মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকটি স্বাক্ষর করেছে।’

সমঝোতা চুক্তি সংক্রান্ত মিয়ানমার সরকারের বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছিল, ২৫ বছর আগে ২ লাখ ৩০ হাজার বাস্তুচ্যুতর প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘকে সহায়তা করেছিল মিয়ানমার।’ তবে রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো মিয়ানমার ও জাতিসংঘের মধ্যে স্বাক্ষরিত পূর্ববর্তী প্রত্যাবাসন চুক্তিগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে বলছে, সেই চুক্তিগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘর পুনর্নির্মাণ করে দিতে এবং তাদের আন্তর্জাতিক সুরক্ষা দিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীসহ ‘রাষ্ট্র ও আঞ্চলিক ক্রীড়ানকদের’ প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে। সেইসঙ্গে রোহিঙ্গা নিধনে দায়ীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের মুখোমুখি করারও সুপারিশ করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর অভিযোগ, কমিউনিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা না করেই, তাদের মতামত ছাড়াই চুক্তিটি সম্পাদিত হয়েছে। এমনকী ওই চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি ও মানবিক সহায়তাবিষয়ক সমন্বয়কারী নাট ওৎসবি জানান, চুক্তির বিষয়বস্তু প্রকাশের ব্যাপারে আলোচনা চলছে। ফ্রন্টিয়ারকে তিনি বলেন, ‘সমঝোতা স্মারকটি হলো ইউএনএইচসিআর, ইউএনডিপি ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক রূপরেখা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি আইনি চুক্তি। সমঝোতা স্মারকের বিষয়বস্তু প্রকাশের ব্যাপারে তিন পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হলে তিন পক্ষেরই সম্মতি লাগবে। বাংলাদেশে থাকা শরণার্থী ও রাখাইনের সব সম্প্রদায়ের লোকজনসহ স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ করার কথা রয়েছে জাতিসংঘের দুই সংস্থার ।’

জাপানি সংবাদমাধ্যম এনএইচকে-তে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সুচি’র বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রচারের দুইদিন পরই বিবৃতিটি দেয় রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো। ওই সাক্ষাৎকারে সুচি বলেছিলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য আস্থা গড়ে তোলার দায়িত্বটি মিয়ানমার ও বাংলাদেশ দুই দেশের উপরেই বর্তায়। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, আস্থা স্থাপনের বিষয়টি কেবল মিয়ানমারের উপর বর্তায় না। আমি মনে করি, আস্থা স্থাপনের জন্য অন্য পক্ষকেও জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।’

তমব্রুর কাছে অস্থায়ী শিবিরে রোহিঙ্গারা
গত বছরের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপ জোরালো হওয়ার এক পর্যায়ে প্রত্যাবাসন চুক্তিতে বাধ্য হয় মিয়ানমার। তবে সেই চুক্তির পর বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও ধোঁয়াশা কাটছে না। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ৮ হাজার রোহিঙ্গার নাম প্রস্তাব করা হলেও মাত্র ৬০০ জনকে ফেরত নিতে চেয়েছে মিয়ানমার। এরমধ্যেই প্রত্যাবাসন প্রশ্নে জাতিসংঘ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমঝোতা চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়।

মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি চুক্তি স্বাক্ষরের পর এক প্রতিবেদনে জানায়, এতে নাগরিকত্বের প্রশ্নের মীমাংসা না হওয়ায় বহু বছর ধরে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের মিথ্যা আশ্বাস পেয়ে আসা রোহিঙ্গারা হতাশ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা তৈয়ব আলী নামে রোহিঙ্গা এপিকে সে সময় বলেন, প্রথমে রাখাইনে থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিতে পারে ইয়াঙ্গুন সরকার। কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে তিনি বলেন, ‘যখন আমরা দেখে শুনে নিশ্চিত হবো যে তারা নাগরিক অধিকার উপভোগ করছে, তখন আমরা ফিরে যাবো।’

উল্লেখ্য, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইনে থাকলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। উগ্র বৌদ্ধবাদকে ব্যবহার করে সেখানকার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্থাপন করেছে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের চিহ্ন। ছড়িয়েছে বিদ্বেষ। ৮২-তে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। এরপর কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোনও নিবন্ধনপত্র,কখনও নীলচে সবুজ রঙের রশিদ,কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনও আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি নামের রং-বেরঙের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে। ধাপে ধাপে মলিন হয়েছে তাদের পরিচয়। ক্রমশ তাদের রূপান্তরিত করা হয়েছে রাষ্ট্রহীন বেনাগরিকে।

বাংলা টিউবুন

Next Post

নালিশ করতে ভারতে গিয়েছিলেন, কাদের।

বুধ জুন ১৩ , ২০১৮
দেশের নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে নালিশ করতে বিএনপি ভারত গিয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন,‘সম্প্রতি তিস্তা ও রোহিঙ্গাসঙ্কটসহ জাতীয় সমস্যা নিয়ে কথা বলার জন্য আমরা ভারত গিয়েছিলাম। এরপরই বিএনপি নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে নালিশ করতে ভারত গিয়েছিল। তারা জাতীয় […]

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links