নিজস্ব প্রতিনিধিঃ পশ্চিমাঞ্চল রেলের দুর্নীতি যেন থামছেই না। একের পর এক দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাচ্ছে রাঘববোয়ালরা। যদিও সম্প্রতি এই অঞ্চলের চারজন অফিসারকে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত করেছে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ। তবে অভিযুক্ত জিএমসহ অন্যান্যরা এখনো আছে বহায়তবিয়তে। যাদের ঘীরে এই সকল দুর্নীতি, তাদেরকেই ঘুরে ফিরে কাজ দিচ্ছেন রেলের কর্মকর্তারা। ইজিবির নামে চলছে ভাওতাবাজি। কারসাজি করে পছন্দের ঠিকাদারকে দেওয়া হচ্ছে কমিশনভিত্তিক কাজ। সম্প্রতি পশ্চিম রেলে যোগ হয়েছেন আরেক দুর্নীতিবাজ প্রধান প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম ফিরোজী। সে যোগদান করে ঠিকাদারের নিকট থেকে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা ঘুষ গ্রহন করেছেন। কোটি টাকার ফাইল পাসের নামে এই টাকা দিয়েই তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সাবেক প্রধান প্রকৌশলীর চলমান কাজের ২০% কমিশন নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সুত্র বলছে, রেলের দুর্নীতিবাজ খ্যাত ঠিকাদার আফসার বিশ্বাসের একক দৌরাত্ম নিয়ে গত বছর ২০ রেলপথ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্যরা চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে সাবেক ডিজি শামসুজ্জামানকে ভর্ৎসনা করেছিলেন। কারণ একটি সিন্ডিকেটকে রেলের শত শত কোটি টাকার কাজ নজিরবিহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়ার একাধিক অভিযোগ সংসদীয় কমিটিতে জমা পড়েছিল। ওই সিন্ডিকেট দেওয়া সব টেন্ডার পর্যালোচনা করে কমিটির সদস্যরা দেখতে পান প্রতিটি ক্ষেত্রেই গুরুতর অনিয়ম হয়েছে।
ওই সিন্ডিকেটটি গত কয়েক বছরে বাগিয়েছেন রেলের শত শত কোটি টাকার কাজ। ডিজির বন্ধু পরিচয়ে তার এই দৌরাত্ম নিয়ে সংসদীয় কমিটি চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। অনিয়ম বন্ধে ব্যবস্থা নিতে রেল সচিব ও ডিজিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। করেছিলেন তদন্ত উপ-কমিটি। কিন্তু তাতে বিশেষ কিছু হেরফের হয়নি। এখনো এ সিন্ডিকেটের সমান দৌরাত্ম পশ্চিম রেলে।
অন্যদিকে ব্যালাষ্ট (পাথর) সরবরাহে অনিয়মের দুদকের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে এমন সব প্রতিষ্টানকে আবারও একই ধরনের কাজ দেওয়ার অভিযোগ করেছেন রেল ঠিকাদারদের একটি অংশ। তারা বলছেন এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাজ না করেই বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান আছে দুদকে। এরপরও দুনীতিতে জড়িত একইসব প্রতিষ্ঠানকে ৯টির মধ্যে ৬টি গ্রুপের কাজ ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে। ইজিপির কারসাজিতে এই কাজগুলো দেওয়া হচ্ছে এই সকল দুর্নীতিবাজদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অতি সম্প্রতি পশ্চিম রেলের ইজিপি টেন্ডারেও গুরুতর কারসাজির মাধ্যমে একটি কনষ্ট্রাকশানকে প্রায় ৪ কোটি টাকার ব্যালাষ্ট (পাথর) সরবরাহের কাজ দেওয়া হয়েছে । আরও প্রায় দুই কোটি টাকার আরেকটি কাজ দেওয়া হয়েছে ওই সিন্ডিকেটের সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে। অথচ ই-জিপি টেন্ডারে টেন্ডারের আবশ্যিক শর্তাবলী পূরণ করেননি। মন্ত্রণালয়ের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার নির্দেশে পশ্চিমাঞ্চল রেলের রেলওয়ের কর্মকর্তারা কারসাজি করে কাজ দিয়েছে বলে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদাররা অভিযোগে বলেছেন। এই কাজের নামে সদ্য যোগদানকৃত প্রধান প্রকৌশলীকে দেওয়া হয়েছে মোটা অংকের কমিশন।
পশ্চিম রেলের বঙ্গবন্ধু পুর্ব থেকে টাঙ্গাইলের মহেড়া পর্যন্ত রেল ট্র্যাকে বালাষ্ট (পাথর) সরবরাহের ১ কোটি ৯১ লাখ ২৩ হাজার টাকা ( টেণ্ডার কোড নং-৫৩৩৫২৬) এবং লালমনিরহাট-কাউনিয়া রেল ট্র্যাকে বালাষ্ট সরবরাহের ১ কোটি ৬০ লাখ ৮০ হাজার টাকার ( টেণ্ডার কোড নং-৫৩৩৫২১) দুটি কাজ আফসার বিশ্বাসসকে দেওয়ার সুপারিশ করেছে পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান প্রকৌশলীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের টেণ্ডার কমিটি।
অন্যদিকে সান্তাহার-তালোড়া পর্যন্ত ট্র্যাক সংস্কারে ব্যালাষ্ট সরবরাহে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকার ( টেন্ডার কোড নং-৫৩৩৫২৩) দেওয়া হয়েছে আফসার সিন্ডিকেটের আরেক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল হাইটেক ইঞ্জিনিয়ারিংকে। অভিযোগ মতে, এসব প্রতিষ্ঠান টেন্ডারের আবশ্যক শর্তাবলী পুরণ করতে না পারলেও অদৃশ্য তদবিরের কারণে এই তিনটি প্রতিষ্ঠানকে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সুপারিশ দিয়েছে টেন্ডার কমিটি। এই সুপারিশ পাঠানো হয়েছে রেল মহাপরিচালকের দপ্তরে। এখন সিন্ডিকেটকে কার্যাদেশ দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগে আরও জানা গেছে, ইজিপি টেণ্ডারে কারচুপির সুযোগ না থাকলেও টেন্ডার কমিটি সিন্ডিকেটকে যোগ্য উল্লেখ করে সুপারিশ দিয়েছে। সূত্র অনুযায়ী ইজিপি-টেন্ডারের নিয়মানুযায়ী এসব কাজের জন্য নিম্নদর দিলেও টেন্ডারের আবশ্যিক শর্তানুযায়ী অন্যান্য নথিপত্র ও নির্দিষ্ট টাকার অভিন্ন কাজের অভিজ্ঞতার সনদসহ সহায়ক সার্টিফিকেট অনলাইনে সংযুক্ত করেননি। বিশেষ করে অনুরূপ কাজের নির্দিষ্ট সময়ে নিদিষ্ট অংকের কাজ সম্পাদনের অভিজ্ঞতা, ব্যাংক সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন নথিপত্র ই-জিপি পদ্ধতির এই টেণ্ডারে এসব নথিপত্র সংযুক্তির কথা বলা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলির মতে, টেণ্ডারের শর্তাবলী অনুযায়ী একটি কোন নথি অনলাইনে জমা না করলেই সেই দরপত্রদাতার প্রস্তাব সরাসরি বাতিল বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু পরবর্তীতে কেউ চাইলেও আর কোনভাবেই অনলাইনে বা সরাসরি মাধ্যমে বাদপড়া নথিপত্র দরপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারেন না। ইজিপির কোড নম্বর দিয়ে অনলাইনে প্রবেশ করে অংশগ্রহণকারী সকল ঠিকাদার পরস্পরের দেওয়া দর ও দাখিলকৃত নথিপত্র চেক করে দেখতে পারেন। ই-জিপিতে একবার নথিপত্র জমা করলে তা দ্বিতীয়বার সংশোধনের সুযোগ থাকে না। কিন্তু টেণ্ডার কমিটি ই-জিপির শর্তাবলী লঙ্ঘন করে তিনটি কাজ আফসার সিন্ডিকেটটে তিনটি কাজের সুপারিশ দিয়েছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম ফিরোজী বলেন, এই টেন্ডারগুলির প্রক্রিয়া তিনি যোগদানের আগেই সম্পন্ন হয়েছে। সুতরাং তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না। তবে কমিশনের বিষয়টি তিনি সুকৌশলে এড়িয়ে যান।
এদিকে টেন্ডার কমিটির সদস্য পাকশীর ডিভিশানাল রেলওয়ে ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম বলেন, ইজিপি টেন্ডারে কারসাজির সুযোগ নেই। নয় গ্রুপের এসব কাজ কাগজপত্র দেখেই যারা যোগ্য তাদেরকে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। বিশ্বাস কনষ্ট্রাকশানও দুটি গ্রুপের কাজে যোগ্য হয়েছেন। ফলে তাকে সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।