আভা ডেস্কঃ গত কয়েক বছর দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো। সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বিনিয়োগ বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও ছিল নানা প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বাস্তবে সুফল মেলেনি।
এ অবস্থায় নতুন বছরেও দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ থাকছে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো। যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা এসব কথা বলেন।
তাদের মতে, বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়নে আগামী বছর কয়েকটি বিষয়ে জোর দিতে হবে। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারে সুশাসন নিশ্চিত করা, রফতানি ও সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং সর্বোপরি বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করা। এছাড়াও টাকা পাচার বন্ধে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি বলে মনে করছেন তারা।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হল বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। এক কথায় বললে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হয়নি।
তিনি বলেন, বিনিয়োগ না হওয়ার মূল কারণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সুশাসনের অভাব। আর এ দুই সমস্যার কোনো উন্নয়ন হয়নি। এছাড়া বাংলাদেশের নিয়মিত সমস্যা হল অবকাঠামোগত দুর্বলতা। বিশেষ করে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ। আর গ্যাস না হলে বিনিয়োগ করা যায় না। এসব কারণে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না।
তার মতে, রেমিটেন্স ছাড়া অর্থনীতির সব সূচক নেতিবাচক। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা, শেয়ারবাজার এবং ঋণের প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত নেতিবাচক। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, কর আদায় পরিস্থিতি। প্রত্যাশা ছিল, নতুন কর আদায় বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে তা কমছে। ফলে অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক নেতিবাচক। এ নেতিবাচক অবস্থা নিয়ে শুরু করেছে নতুন বছর। ফলে বলা যাচ্ছে অর্থনীতি ভিত্তিটি শক্তিশালী নয়। এ দুর্বল ভিত্তির ওপরই নতুন বছরে ভিত রচিত হবে। এক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, আগামীতেও বড় চ্যালেঞ্জ হবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো। তিনি বলেন, মূলধন সংগ্রহের দুটি খাতই দুর্বল। এ খাতগুলোকে শক্তিশালী করে ব্যবসায়ীদের সহজে পুঁজির জোগান দিতে হবে। না হলে বিনিয়োগ বাড়বে না। সামগ্রিকভাবে যা কর্মসংস্থান এবং পুরো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
একটি দেশে বিনিয়োগ বাড়লে তিনটি নির্দেশক দিয়ে বোঝা যায়। প্রথমত, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়বে। একই ভাবে বাড়বে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি। এক্ষেত্রে চলতি মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৩ দশমিক ২ শতাংশ।
কিন্তু গত বছরের আগস্টে এ হার ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ, সেপ্টেম্বর আরও কমে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ, অক্টোবরে ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ এবং সর্বশেষ নভেম্বরে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
অন্যদিকে আগের বছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ২ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। আর এ তিন সূচকের সম্মিলিত বার্তা হল দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে না।
বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে, একটি দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য মৌলিকভাবে ৭টি পূর্বশর্ত থাকে। এগুলো হল- পুঁজির সহজ লভ্যতা, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ, পর্যাপ্ত জমি, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহসহ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্থিতিশীল কর কাঠামো, দক্ষ শ্রমিক এবং আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে সহজ ব্যবস্থাপনা।
কিন্তু এসব সূচকের কোনোটিই বাংলাদেশে উন্নতি হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নেই। তবে অনিশ্চয়তা কাটেনি। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ।
প্রতি বছর দেশে যে হারে বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়, বাস্তবায়ন হার তার ধারেকাছেও নেই। আবার যেটুকু বাস্তবায়ন হয়, তার পুরোটাই বিদেশি পুনর্বিনিয়োগ। কাগজে-কলমে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়লেও তার সুফল পাচ্ছে না দেশ।
এছাড়া নতুন বিনিয়োগ বাস্তবায়নের হার একেবারেই সামান্য। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্র বলছে, বড় দেশগুলোর পক্ষ থেকে যে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি আসে, নানা জটিলতায় শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয় না।
এদিকে টানা কয়েক বছর থেকে চলে আসা বিনিয়োগে খরা কাটাতে বছরের শুরুতে অনেক হাঁকডাক ছিল। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও ব্যাপক প্রতিশ্রুতি ছিল। উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন প্রণোদনার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কোনো সুখবর নেই। বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতাগুলো আগের জায়গায়ই রয়েছে। ফলে বাড়েনি বিনিয়োগ।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এরমধ্যে রয়েছে বেসরকারি, সরকারি এবং বিদেশি বিনিয়োগ। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া উচিত। সবার আগে ব্যাংকিং খাত ঠিক করতে হবে। এছাড়াও সরকারের রাজস্ব আয় এবং রফতানি বাড়ানো জরুরি।
তার মতে, ব্যাংক থেকে সহজে পুঁজি না পেলে বিনিয়োগ সম্ভব নয়। আর ব্যাংকিং খাত ঠিক হলে তারল্য বাড়বে। এতে সহজ হবে পুঁজি জোগান। অন্যদিকে রাজস্ব আয় বাড়লে সরকারের ঋণনির্ভরতা কমবে। পাশাপাশি রফতানি আয় বাড়লে বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য আসবে।
তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার। কারণ উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হবে না। এছাড়াও দেশ থেকে টাকা পাচার বন্ধে সরকারকে বড় ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু বিনিয়োগ নয় দেশের অর্থনীতির মৌলিক সূচকগুলোর মধ্যে রেমিটেন্স ছাড়া সবই নেতিবাচক। আমদানি, রফতানি, সরকারের রাজস্ব আদায়, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ এবং ব্যাংক ও পুঁজিবাজারসহ কোনো খাতই ভালো নয়।
এছাড়াও উৎপাদনশীল খাতের মধ্যে গার্মেন্টস, বস্ত্র, সিমেন্ট এবং সিরামিক কোনো খাতেই আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। অর্থনীতির দুর্বল অবস্থা নিয়ে শুরু হচ্ছে নতুন বছর। ফলে আগামী বছরে দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ থাকছে, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো।
সেই সঙ্গে ব্যাংক ও শেয়ারবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি প্রতিরোধ, দেশ থেকে টাকা পাচার বন্ধ করা এবং নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো চ্যালেঞ্জ তো থাকছেই। তাদের মতে, বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান এবং কর আদায় বৃদ্ধি সম্ভব নয়।
আর সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হতে পারবে না। এ বিবেচনায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
জানা গেছে- দেশে নতুন কর্মসংস্থান তৈরির জন্য শিল্পায়নে বিনিয়োগ অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর বিনিয়োগে পুঁজি সংগ্রহের দুটি খাত হল ব্যাংক ও শেয়ারবাজার। কিন্তু গত কয়েক বছর পর্যন্ত ব্যাংকের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট ৯ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১২ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএফএফ) হিসাবে তা ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা।
যা মোট ঋণের ২৬ শতাংশ। এছাড়া ব্যাংকিংবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু নামেই বেঁচে আছে। দেউলিয়ার পথে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিু। অন্যদিকে শেয়ারবাজারের অবস্থা আরও খারাপ।
গত এক বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে ৮২ হাজার কোটি টাকা। অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম তলানিতে। সরকারি-বেসরকারি হিসাবেই কমছে বিনিয়োগ। কমে আসছে রফতানি আয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, আগামী বছর অর্থনীতিতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কারণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি এবং রেমিটেন্স ছাড়া অর্থনীতির সবগুলো নেতিবাচক।
তিনি বলেন, পুরনো পুঞ্জীভূত ভুলের জন্য আগামীতে খেসারত দিতে হবে। আমদানি-রফতানির অবস্থা খারাপ। নতুন সরকারের শুরু থেকে ব্যাংকিং খাত উল্টো দিকে চলতে শুরু করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবস্থা খারাপ নয়। তবে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের অবস্থা ভালো নয়। এদিকে নজর দিতে হবে। এ বিষয়ে বিবেচনা করে আগামী বছরের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
যুগান্তর