সোহানুল হক পারভেজ,তানোর( রাজশাহী): রাজশাহীর তানোরের পাঁচন্দর ইউপির দুবইল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলাম দীর্ঘ প্রায় ২২ বছর ধরে শিক্ষকতা করলেও এখানো তার এমপিওভুক্ত হয়নি। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনি চরম মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। তিনি দুই দশকের বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করে আসছেন, এটাই তাঁর পেশা এবং আয়ের উৎস। কিন্তু এখানো এমপিভুক্ত হতে না পেরে এখন তিনি বর্গা চাষ করে চার সদস্যর পরিবার চালাতে রিতিমত হিমশিম খাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, প্রধান শিক্ষক ও তার ভাই স্কুলের সভাপতির কারসাজির কারণে আনোয়ারুল এমপিও বঞ্চিত রয়েছে। তিনি বলেন, নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে তার এমপিও সম্ভব ছিল তবে তাদের কারসাজিতে তিনি এমপিও বঞ্চিত হয়েছেন।
জানা গেছে, উপজেলার দুবইল উচ্চবিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই শিক্ষকতা করে আসছেন আনোয়ারুল ইসলাম। কিন্তু ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠানটি নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এমপিও ভুক্ত হলেও এখনো তাঁর পদ এমপিও ভুক্ত হয়নি। ফলে তাঁর চাকরি ও প্রতিষ্ঠানের বয়স একই হলেও এখন তাঁর পেশা থেকে উপার্জন প্রায় শূন্য বলা যায়। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আনোয়ারুল ইসলাম তৃতীয়। বাবা আলতাব হোসেন ছিলেন কৃষক। তাঁদের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের ইসলামপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মী নারায়ণপুরে। বিঘা সাতেক ধানি জমি থেকে সংসার চলতো তাঁদের। বাবা-ভাইদের সঙ্গে তিনিও কাজ করতেন খেতে। তাতে সংসারের চাকা সচল ছিল। তবে সর্বনাশা পদ্মার পেটে চলে গেছে সহায়-সম্বল। বাস্তুচ্যুত হয়ে ভাইয়েরা যে যার মতো ঠিকানা গড়েছেন। তিনিও আবাস গড়েন তানোরের পাঁচন্দর ইউনিয়নের যোগিশো এলাকায়। সরকারি খাস জমিতে গড়েছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই। ১৯৯৯ সালে এলাকায় প্রতিষ্ঠা পায় দুবইল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। আনোয়ারুল সেখানে যোগ দেন সহকারী শিক্ষক হিসেবে।আনোয়ারুলের আশা ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সঙ্গে একদিন তাঁরও ভাগ্যের উন্নয়ন হবে। ২০১০ সালে বিদ্যালয়টির নিম্নমাধ্যমিক স্তর এমপিওভুক্ত হলে আশা জাগে। সর্বশেষ ২০২০ সালে মাধ্যমিক স্তরও এমপিওভুক্ত হয়। কিন্তু এমপিও বঞ্চিত রয়ে যান শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলাম। এ জন্য অবশ্য নিজের কপালকেই দুষছেন তিনি।
আনোয়ারুলের ভাষ্য, সরকারি বিধি মোতাবেক ২০০৩ সালে তিনি সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পান। শুরু থেকেই ওই পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। এরই ফাঁকে ২০০৯ সালে তিনি পঞ্চম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সমাজবিজ্ঞান (সহকারী শিক্ষক) বিষয়ে উত্তীর্ণ হন। এর পর ২০১১ সালের ৯ আগস্ট সরকারি বিধি মেনে মাধ্যমিক স্তরে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তাঁকে সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি) হিসেবে এমপিওভুক্তির আবেদন পাঠান প্রধান শিক্ষক। কিন্তু ডিগ্রি স্তরে ইংরেজি বিষয়ে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৩০০ না থাকায় সেই আবেদন বাতিল হয়ে যায়। পরে এমপিওভুক্তির জন্য আনোয়ারুলের আগের নিয়োগ সামনে এনে এমপিও আবেদন পাঠান প্রধান শিক্ষক। ফলে দুই দফা দুই রকম তথ্য দিয়ে আবেদন করায় সেবারও তাঁর আবেদন আটকে যায়। আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, তিনি একেবারেই ভূমিহীন। মেয়ে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। স্ত্রীও অসুস্থ। সামান্য জমি বর্গা চাষ করে কোনো রকমে সংসার চালান। সন্তানদের পড়ালেখা, পরিবারের ভরণপোষণ করা এখন তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা মহামারি সংকট আরও বাড়িয়েছে।
বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেছেন দুবইল উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, শুরু থেকেই তিনি বিদ্যালয়টিতে দায়িত্ব পালন করছেন। মাধ্যমিক স্তরে তাঁর সর্বশেষ নিয়োগ থাকায় নিম্নমাধ্যমিক স্তরে তাঁকে শিক্ষক হিসেবে দেখানো হয়নি। আবার তাঁর সেই নিয়োগের এমপিও শর্ত পূরণ না হওয়ায় বাতিল করে দেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের আঞ্চলিক উপপরিচালক। পরের দফায় তাঁর আগের নিয়োগ সামনে এনে আবেদন করা হয়। ওই নিয়োগের সময় এমন কোনো শর্ত ছিল না। কিন্তু দুবার পৃথক আবেদনের কারণে সেটিও বাতিল হয়ে যায়। তাঁর জন্য অনেক চেষ্টা করেও কিছুই করা যায়নি।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের উপপরিচালক ড. শরমিন ফেরদৌস চৌধুরী জানান, সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি) হিসেবে এমপিওভুক্তির জন্য তাঁর শর্ত পূরণ না হওয়ায় আবেদনটি বাতিল করা হয়েছে। এর পর তিনি পুরোনো নিয়োগ দেখিয়ে ফের এমপিওভুক্তির আবেদন করেন। কিন্তু দুবার দুই রকম তথ্য দিয়ে আবেদন করায় বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। ওই শিক্ষক বিষয়টি নিয়ে এসেছিলেন। এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মতামত পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।