জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দৌড়ে থাকা নেতাদের কোন্দলে জর্জরিত রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ। কলহ-বিবাদের জেরে বেশ কিছুদিন ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ অনেক নেতা নিয়মিত মিটিংসহ দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকছেন। এছাড়া পবা, বাগমারা, পুঠিয়া, দুর্গাপুর, তানোর, গোদাগাড়ী, চারঘাট, বাঘা উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের কমিটিগুলোতেও দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছে। এসব তৃণমূল সাংগঠনিক ইউনিটের নেতাকর্মীরা কোথাও একসঙ্গে কোনো কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন না। অনেক জায়গাতেই নেতাকর্মীরা দুই বা তার অধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছেন। এতে দলের ভেতরের সংহতি বিনষ্টের পাশাপাশি বেড়েছে বিভক্তি।
এদিকে জেলা নেতাদের অনেকেই কেন্দ্রে পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযোগ দেয়ায় দলীয় ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলাও প্রায় ভেঙে পড়েছে। দলীয় নেতাকর্মীরা ক্ষোভের সঙ্গে জানান, জাতীয় শোক দিবসের মতো কর্মসূচিতেও রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা জোটবদ্ধ অবস্থায় অংশ নেননি। এমনকি উপজেলা ও পৌর কমিটিগুলোও জোটবদ্ধভাবে কর্মসূচি পালন করেনি। মনোনয়ন দৌড়ে থাকা কতিপয় নেতা নিজ নিজ অনুসারী নিয়ে দলের অভ্যন্তরে নিজস্ব বলয় তৈরি করায় এ বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে বলে কয়েকজন সংসদ সদস্য মনে করছেন। জানা গেছে, রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী ১৭ আগস্ট জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচিতে অংশ নেননি। এর আগে ১৫ আগস্ট তিনি গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত শোক দিবসের কর্মসূচিতে অংশ নেন এবং উপজেলা বিএনপির সভাপতি ইসাহাক আলীকে দলে যোগদান করান। এ নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এর আগেও ওমর ফারুক চৌধুরী জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিভিন্ন জাতীয় ও দলীয় কর্মসূচি বর্জন করেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়টি সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদের দখলে। তিনি ইচ্ছামতো কর্মসূচি গ্রহণ ও পালন করেন। অন্য নেতাকর্মীদের জানানো হয় না। দলীয় কার্যালয়কে ব্যক্তিগত চেম্বার বানিয়ে ফেলায় সেখানে যাওয়ার মতো পরিবেশ নেই।
তবে জেলা সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নিজ দায়িত্বে দলীয় ও জাতীয় কর্মসূচি পালন করবেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন- উনাকে আলাদা করে বলতে হবে কেন।
অভিযোগ উঠেছে, ১৮ আগস্ট গোদাগাড়ীর আলোকছত্র স্কুলে জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি শেষে ফেরার পথে সাধুর মোড় নামক স্থানে এমপি সমর্থক নেতাকর্মীদের হাতে আক্রান্ত হন জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও রাজশাহী-১ আসনে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী মতিউর রহমান। সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মতিউর রহমানের অভিযোগ, এমপি ফারুক চৌধুরীর ইঙ্গিতেই তার গাড়ির ওপর হামলা হয়েছে। এ হামলায় ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন। এ ঘটনায় উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পারভেজ বাবুসহ ১০ জন দলীয় নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে।
তবে মতিউর রহমানের গাড়িতে হামলায় এমপি ফারুক চৌধুরীর সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পারভেজ বাবু বলেন, মতিউর রহমান দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে তাতে নিজে অংশ নিচ্ছেন। এজন্য দলীয় নেতাকর্র্মীরা তাকে প্রতিরোধ করেছেন মাত্র। তার গাড়িতে হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন তিনি।
অন্যদিকে তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রাব্বানী নৌকার পক্ষে পৃথক গণসংযোগ করছেন রাজশাহী-১ আসনের গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলায়। প্রায় বছরখানেক ধরে গোলাম রাব্বানী এ আসন থেকে দলের মনোনয়ন চেয়ে পোস্টারিংয়ের পাশাপাশি সভা-সমাবেশ করছেন। গোলাম রাব্বানীর অভিযোগ, তার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। তার সমাবেশে যারা আসছেন তাদের হুমকি দেয়া হচ্ছে। অনেকেই ভয়ে আত্মগোপন করেছেন। জানা গেছে, তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেও রাব্বানী দলীয় কোনো কর্মসূচিতে যেতে পারেন না এমপি অনুসারীদের ভয়ে।
বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকিরুল ইসলাম সান্টু মনোনয়ন পেতে বেশ কিছুদিন ধরে গণসংযোগ করছেন। ফলে দলীয় ও জাতীয় কর্মসূচিতে সান্টুকে দেখা যায় না বছরখানেকের বেশি সময় ধরে। সান্টুর বদলে বাগমারায় দলীয় কর্মসূচিতে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন গোলাম সারোয়ার আবুল। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক বলেন, সান্টু দল ও দলের নেতাকর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। তার কর্মকাণ্ডে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে যোগাযোগ করেও সান্টুর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের পবা উপজেলা আওয়ামী লীগে বিভাজন দীর্ঘদিন ধরে। উপজেলা আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচিতে এলাকার এমপি আয়েন উদ্দিন থাকেন না। থাকেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ। জানা গেছে, পবা উপজেলা সভাপতি ইয়াসিন আলী ও সাধারণ সম্পাদক মাজদার রহমানকেও এমপির কর্মসূচিতে দেখা যায় না। দলীয় সূত্রমতে, জেলা সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান এ আসনে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশায় গণসংযোগ ছাড়াও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। এতেই পবা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দ্বি-ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েন।
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের এমপি আবদুল ওয়াদুদ দারার বিপরীতে দুই উপজেলা আওয়ামী লীগে একটি শক্তিশালী বলয় সক্রিয় রয়েছে। জানা গেছে, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহসানুল হক মাসুদ এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মজিদ সরদারও এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। ফলে পুঠিয়া দুর্গাপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ত্রি-ধারায় বিভক্ত।
জানা গেছে, পুঠিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মালেকসহ দুর্গাপুর উপজেলা ও পৌর কমিটি এলাকার এমপির বিপরীতে পৃথক কর্মসূচি পালন করে। এসব কর্মসূচিতে মাসুদ অংশগ্রহণ করেন। অন্যদিকে এমপি দলের একটা অংশকে নিয়ে পৃথক কর্মসূচি পালন করে থাকেন।
জেলা, উপজেলা ও পৌর কমিটিতে দলীয় নেতাকর্মীদের বিভক্তি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চলমান সংকট নিরসনে আমরা কয়েকবারই কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ চেয়েছি। এসব সমস্যার সমাধান আমরা নিজেরা করতে পারিনি। কারণ জেলায় দলের কতিপয় এমপি দলীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। তারা সহযোগিতা করলে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। online
