কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে নতুন প্রজন্ম স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না।

ava desk : কৃষিতে মুনাফা কম হওয়ায় নতুন প্রজন্মের কাছে ‘কৃষি পেশা’ গুরুত্ব হারাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি খাতের ক্ষতিপূরণে কেউ এগিয়ে আসে না। দায়িত্বও কেউ নেয় না। এ খাতে বিনিয়োগেও রয়েছে অনিশ্চয়তা। এ সব কারণে কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে নতুন প্রজন্ম স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। এছাড়া এ পেশায় সন্তানদের আনতে কৃষকরাও খুব বেশি উৎসাহিত নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং এ খাতে মুনাফা বাড়াতে হবে। কৃষক উন্নয়নে গুরুত্ব না দেয়া হলে আগামীতে কৃষি পেশায় লোকবলের সংকট দেখা দেবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেবে।

সূত্রমতে, এক সময়ে ৮৫ শতাংশ লোক কৃষিকাজে জড়িত থাকলে পর্যায়ক্রমে কমে ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। মূলত নতুন প্রজন্ম ও কৃষকগোষ্ঠীর পরিবার মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় এই সংখ্যা কমেছে। বিবিএসের তথ্যমতে, বর্তমানে সারা দেশে কৃষি পরিবারের সংখ্যা হল প্রায় এক কোটি ৫২ লাখ। এদিকে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অবদানও কমছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ১৪ দশমিক ৬৫ শতংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা কমে ১০ দশমিক ৫৪ শতাংশে নেমেছে।

১১ থেকে ১৩ জুলাই বগুড়া, রাজশাহী ও নওগাঁর বিভিন্ন অঞ্চল সরেজমিনে পরিদর্শন ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলা হয়। সংশ্লিষ্ট জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা হয়। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পায় না কৃষক। মুনাফা কম হওয়া, বিনিয়োগে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা থাকা, হিমাগারের অভাব, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন না করা, শস্যবীমার ব্যবস্থা না থাকা, ঋণ পাওয়ার জটিলতাসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন কৃষকরা। অথচ জাতীয় কৃষিনীতি-২০০৮ এ এই সব সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ নেয়ার কথা ছিল। তবে সম্প্রতি পাস হওয়া জাতীয় কৃষিনীতি-২০১৮ তে এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক এমকে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, মুনাফা কমে যাওয়ায় নবীন জনগোষ্ঠী কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে না। এজন্য কৃষিপণ্যে মূল্য সংযোজন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে কৃষকের উন্নয়নে উদ্যোগ নিতে হবে। অতীতে কৃষি উন্নয়নের কথা বলা হলেও কৃষকের কথা বলা হয়নি। শুধু কৃষি উন্নয়ন নয়, কৃষকের কথাও এখন ভাবতে হবে। তিনি আরও বলেন, কৃষকের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে শস্যবীমা চালুসহ আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে সরকার। এটি না হলে ভবিষতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, দেশে কর্মসংস্থান সংকট নিরসনে কৃষিকে বিকল্প পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। এজন্য কৃষি খাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। যুগান্তরকে তিনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করলে নতুন প্রজন্মের কাছে কৃষি আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে গড়ে উঠবে। তিনি আরও বলেন, প্রত্যেকের ধারণা সরকারি চাকরি হল সবচেয়ে ভালো। এরপর পেশা হিসেবে ব্যবসা ও বেসরকারি চাকরিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু শিক্ষিত হলে আর কৃষিকাজ করা যাবে না- এমন মনমানসিকতা বিরাজ করছে। এসব পরিহার করতে হবে।

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের চান্দাইকোনা বাজারে ১১ জুলাই দুপুরে কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। কৃষক হাফিজ জানান, বর্তমানে কৃষি খাতে পরিশ্রম হলেও ন্যায্যমূল্য নেই। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়। এ কারণে সংসারের খরচ জোগাড় করাই কঠিন হয়ে পড়ে। সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়ানো, ভালো পোশাক ও খাবার দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। নিজের সন্তানকে কৃষিতে সংযুক্ত করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কৃষিতে আসলে আয়-রোজগার নেই। সন্তান কৃষক হলে আমার মতোই তার অবস্থা হবে। আমি চাই সন্তান শিক্ষা অর্জন করে ভালো চাকরি করুক। একই গ্রামের কৃষক আবদুর রাজ্জাক বলেন, টমেটো ছাড়া ধানসহ অন্যসব পণ্য উৎপাদনে লোকসান হয়। এছাড়া মজুরি ও উৎপাদন ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু পণ্য বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য পাওয়া যায় না। তবে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হলে কৃষক এ পেশা ছেড়ে যাবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। কৃষিতে বিনিয়োগের নিরাপত্তা না থাকা প্রসঙ্গে কৃষক আবদুল মান্নান শেখ জানান, শস্য অনেক সময় রোগে আক্রান্ত হয়। অনেক সময় ক্ষেতেই সব শস্য নষ্ট হয়ে যায়। গত বছর ক্ষেতেই তার টমেটো সব শেষ হয়ে গেছে। এ জন্য তিনি বড় ধরনের লোকসানে পড়েছেন। লোকসান কাটিয়ে উঠে তিনি এ বছর টমেটো চাষ করার সাহস পাচ্ছেন না।

এদিকে হিমাগারের অভাবে মধ্যস্বত্বভোগীদের জিম্মির কথা তুলে ধরে কৃষক মো. শাখাওয়াত হোসেন জানান, এ অঞ্চলে কোনো হিমাগার নেই। ফলে টমেটো পেকে গেলে সংরক্ষণ করা যায় না। ফলে ঢাকায় ১০০ টাকা কেজিতে টমেটো বিক্রি হলেও এখানে ২০ থেকে ৩০ টাকায়ও বিক্রি হয় না। হিমাগার থাকলে মূল্য নিয়ে কষাকষির সুযোগ পেত কৃষক। কিন্তু এই সুযোগ নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা।

কৃষির মুনাফা প্রসঙ্গে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক প্রতুল চন্দ্র সরকার বলেন, মুনাফা না থাকায় অনেকে কৃষি পেশায় যাচ্ছে না। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এ বছর বগুড়ায় ১২ লাখ টন আলুর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলে প্রকৃত উৎপাদন ১৪ লাখ টন হয়েছে। বেশি উৎপাদনই কৃষকের কাল হয়েছে। কারণ অতিরিক্ত পণ্য নষ্ট হচ্ছে।

কৃষি পেশায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য দেখা গেছে উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় পাইকারি সবজির হাট মহাস্থান হাটে। সেখানে কৃষকের কাছ থেকে ২০ টাকা মূল্যে প্রতি পিস লাউ কেনেন সিলেটের ফড়িয়া ইকবাল। ৬ হাজার পিস লাউ তিনি একটি ট্রাকে নেন। মহাস্থান হাট থেকে সিলেটের ট্রাক ভাড়া ২২ হাজার টাকা, ব্রিজের টোল ১৪০০ টাকা এবং পুলিশের চাঁদা ১৫০০ টাকা নিয়ে তার মোট খরচ প্রায় ২৫ হাজার টাকা। ইকবাল বলেন, সিলেটে প্রতি পিস লাউ ৩৫ টাকা বিক্রি হবে। উল্লিখিত খরচ বাদ দেয়ার পরও তার মুনাফা থাকবে ৬৫ হাজার টাকা। অথচ লাউ চাষীরা আক্ষেপ করে বলেন, পণ্য বেচে তাদের কোনো রকমে খরচটুকু উঠে আসছে মাত্র। মুনাফা হয়নি। এছাড়া মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে চাতাল মালিকরাও কাজ করছে।

নওগাঁ গানিতিপুর থানার পসরা গ্রামের কৃষক সাইদুল ইসলাম জানান, এ বছর ধান ওঠার পরপর অনেক বৃষ্টি হয়েছে। ধান শুকানো সম্ভব হয়নি। এ কারণে মিলারদের কাছে কম দামে ধান বিক্রি করতে হয়েছে। একই গ্রামের কৃষক আলতাব বলেন, প্রতি মণ ধান তারা সে সময় ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। একরকম লোকসান দিয়েই ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি। চাতাল সিন্ডিকেটের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে নওগাঁর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান। তার মতে, অটো রাইস মিল মালিকদের চক্রটি খুবই শক্তিশালী।

মিলারদের অপতৎপরতার কথা স্বীকার করে নওগাঁর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মনজিদ মল্লিক বলেন, সুযোগ বুঝে কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে নেয়া হয়। এটি দেখার দায়িত্ব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। কৃষক সঠিক মূল্য পাচ্ছে না এটি সত্য। তার মতে, কৃষিতে পরিবর্তন আনতে হবে। তা না হলে কৃষিকে পেশা হিসেবে নতুন প্রজন্ম বেছে নেবে না।

নতুন প্রজন্ম কৃষিতে না আসার অন্যতম কারণ হল এ খাতে বিনিয়োগের নিরাপত্তা নেই। এ ব্যাপারে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোগড়াতলার কয়েক কৃষকের সঙ্গে কথা হয়। আমচাষী শহিদুল ইসলাম, আব্বাস মিয়া জানান, উঁচু জমি থাকায় এ অঞ্চলের ধানের ফলন কম হয়। ধান চাষে বরাবর লোকসানের কারণে আমবাগান করেছেন তারা। কিন্তু এ বছর আমের ফলন বেশি হওয়ায় তাদের বড় ধরনের লোকসান গুনতে হচ্ছে। প্রতি মণ আম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। গাছ থেকে আম নামানোর দামও পাওয়া যায়নি।
jugantor

Next Post

তিন মহানগর পুলিশ কমিশনারকে ঢাকায় ডেকেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

বুধ জুলাই ২৫ , ২০১৮
আভা ডেস্ক : রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার এবং এই তিন মহানগর পুলিশ কমিশনারকে ঢাকায় ডেকেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তিন সিটিতে ভোটগ্রহণের ৪ দিন আগে আজ বুধবার তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন নির্বাচন কমিশনাররা। তবে তিন সিটির রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বৈঠকে ডাকা হয়নি। হঠাৎ করে ডাকা এ বৈঠক থেকে সুষ্ঠু ভোট […]

এই রকম আরও খবর

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links