আভা ডেস্কঃ দুটি পোষা কুকুর নিয়ে এমন সব কাণ্ড ঘটেছে যে তাকে লঙ্কাকাণ্ড বললেও কম বলা হবে। থানা পুলিশ থেকে শুরু করে অভিযোগ গেছে খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত। কিন্তু কুকুরপ্রেমী দুটি পক্ষের কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন। এক পক্ষ আরেক পক্ষের চেয়ে ক্ষমতাবান ও শক্তিশালী।
ফলে কুকুরকে কেন্দ্র করে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের যেন শেষ নেই। এমনকি এ অভিযোগ নিয়ে দুই পক্ষ গত কয়েকদিনে সরকারের যেসব শীর্ষ পর্যায়ে নালিশ জানিয়েছেন সেখানে সাধারণ মানুষের পক্ষে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব।
ঘটনার শুরু যেভাবে : ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার বাসিন্দা খায়রুল বাশারের বাড়িতে দুটি জার্মান শেফার্ড জাতের কুকুর ছিল। খায়রুল বাশার ইটালিয়ান ট্রেড কমিশনে উঁচুপদে চাকরি করতেন। এখন তিনি বার্ধক্যে পৌঁছেছেন এবং ইতালি সরকারের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি এখন দেশে থাকেন।
কিন্তু অভিযোগ আছে, তার ধানমণ্ডির বাড়িতে থাকা জার্মান শেফার্ড কুকুর দুটিকে ঠিকমতো দেখভাল করা হয় না এবং মাঝেমধ্যে নির্যাতনও করা হয়। অভিযোগ পায় প্রাণীপ্রেমী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘কেয়ার ফর পজ’।
অভিযোগের সূত্র ধরে তারা পৌঁছে যান খায়রুল বাশারের বাড়িতে। ধানমণ্ডি থানা পুলিশের সহায়তায় কুকুর দুটিকে উদ্ধার করা হয়। ১৭ এপ্রিল ধানমণ্ডি থানায় বসে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা বৈঠকের পর কুকুরের মালিক খায়রুল বাশার সাদা কাগজে লিখিত দেন যে, তিনি এখন থেকে কুকুর দুটির মালিকানা স্বত্ব ত্যাগ করলেন।
তবে মাঝে মাঝে তিনি প্রাণী দুটির সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারবেন। কেয়ার ফর পজের পক্ষে দুটি কুকুর বুঝে নিয়ে থানায় লিখিত প্রাপ্তি স্বীকার পত্র দেন সংগঠনের সভাপতি সৌরভ শামীম। এরপর প্রাণীপ্রেমী সংগঠনের সদস্যরা কুকুর দুটি নিয়ে চলে যান কেরানীগঞ্জে অবস্থিত তাদের প্রাণী পরিচর্যা কেন্দ্রে।
কিন্তু কিছুুদিন পরই খায়রুল বাশার তার কুকুর দুটি ফেরত চান। ফের নির্যাতন করা হবে এ অজুহাতে তা ফেরত দিতে অস্বীকার করেন কেয়ার ফর পজের সদস্যরা।
একপর্যায়ে শুরু হয় বাদানুবাদ ও ক্ষমতার লড়াই। কেয়ার ফর পজ যুক্তি দেয়- কুকুরসহ যে কোনো প্রাণী নির্যাতন আইনত অপরাধ। বাংলাদেশে কিছুদিন আগেও এ সংক্রান্ত আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। তাই দুটি অসহায় পশুকে তারা নির্যাতনের মুখে ঠেলে দিতে পারেন না।
কিন্তু খায়রুল বাশারও নাছোড়বান্দা। কুকুর ফেরত পেতে তিনি সরকারের উচ্চপর্যায়ে দেনদরবার নিয়ে হাজির হন। এর ফলও পান তিনি হাতেনাতে। সরকারের উপর মহল থেকে ধানমণ্ডি থানায় ফোন আসে। নির্দেশ দেয়া হয়, অবিলম্বে কুকুর দুটি ফেরত দেয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে।
এরপর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা বিভাগ রীতিমতো নড়েচড়ে বসে। কুকুর উদ্ধারে থানার ওসির ঘুম হারাম হয়ে যায়। হাই ভোল্টেজ তদবিরের কারণে তার চাকরি প্রায় যায় যায় অবস্থা।
এমন জটিল পরিস্থিতিতে পুলিশের চাপ সামলাতে না পেরে বুধবার খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দফতরে নালিশ নিয়ে হাজির হন প্রাণীপ্রেমী সংগঠনের সদস্যরা। দুপুরে তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মন্ত্রণালয়ের অভ্যর্থনা কক্ষে অপেক্ষা করছিলেন।
এ সময় সেখানে উপস্থিত প্রতিবেদককে সবিস্তারে ঘটনা খুলে বলেন প্রাণীপ্রেমী নোনা আহমেদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘খায়রুল বাশার একজন বয়োবৃদ্ধ। তার পক্ষে কুকুর দুটির লালন-পালন করা সম্ভব নয়। সে কথা তো তিনি থানায় বসে লিখিত দিয়ে এসেছেন। তাহলে এখন কেন তিনি প্রাণী দুটি ফেরত চাইছেন। দুটি প্রাণী সেখানে ভয়াবহ নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে।
তিনি জানান, আমাদের আইনজীবী এ বিষয়ে মামলার প্রস্তুতিও নিচ্ছে। আমরা দুটি অসহায় প্রাণীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না। দেশের আইন সেকথা বলে না।’
নোনা আহমেদ তাদের আইনজীবী নূর জান্নাতুল কারার তিথির সঙ্গে খায়রুল বাশারের উত্তেজিত কথোপকথনের দুটি অডিও রেকর্ডও দেন। ওই কথোপকথন ছিল নিুরূপ-
আইনজীবী : হ্যালো, এটা কি খায়রুল বাশার (কুকুর দুটির মূল মালিক) সাহেবের নম্বর?
খায়রুল বাশার : জি বলছি।
আইনজীবী : আমি কেয়ার ফর পজের লিগ্যাল আইনজীবী বলছিলাম,
খায়রুল বাশার : আপনি থানার ওসির সঙ্গে কথা বলেন। আপনারা নিয়ে গেছেন আপনাদের সঙ্গে আমার আলাপ শেষ।
আইনজীবী : না আমি তো ওসির সঙ্গে কথা বলব না। আপনি নির্যাতন করতেন বলেই তো আমি কুকুরগুলো নিয়ে গেছি।
খায়রুল বাশার : আমার কুকুর আমি নির্যাতন করেছি কি না করেছি এটা আমার ব্যাপার।
আইনজীবী : অবশ্যই না, এটা আপনার ব্যাপার না। আপনি কুকুর নির্যাতন করতে পারেন না।
খায়রুল বাশারের সঙ্গে উত্তেজিত কথাবার্তার একপর্যায়ে ফোনের সংযোগ কেটে গেলে প্রাণীপ্রেমী সংগঠনের আইনজীবী নূর জান্নাতুল কারার ধানমণ্ডির ওসি আবদুল লতিফের নম্বরে ফোন দেন। ওসির সঙ্গে কথোপকথন ছিল নিুরূপ-
আইনজীবী : ওসি ধানমণ্ডি লতিফ সাহেব বলছেন?
ওসি : জি বলছি।
আইনজীবী : ভাইয়া, কুকুর দুটো নিয়ে কি হয়েছে একটু বলেন তো ভাইয়া।
ওসি : ওই যে খায়রুল বাশারের দুইটা কুকুর?
আইনজীবী : হ্যাঁ।
ওসি : কুকুর দুটি ধানমণ্ডিতে পৌঁছে দিতে হবে।
আইনজীবী : কি কারণে। কার অর্ডার। এটা কোনো কোর্টের অর্ডার?
ওসি : কোর্টের না। উনার কুকুর উনি চাচ্ছেন।
আইনজীবী : না না আমি বলি আপনাকে…।
ওসি : এতকিছু বোঝান লাগবে না। উনার কুকুর আপনি উনাকে বুঝিয়ে দেবেন।
আইনজীবী : আমি অ্যাডভোকেট। আপনি কুকুর নিতে হলে আইন ফলো করতে হবে। না হলে আমি আইজি সেলে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করব।
ওসি : আপনি উনার সঙ্গে কথা বলেন। তাকে বলেন, আপনি কুকুর দিয়ে দিয়েছেন এখন কেন ফেরত চাচ্ছেন। আপনি যখন পুলিশের সহায়তা চেয়েছেন পেয়েছেন। এখন আপনি আমার উপকার করবেন না? লারনেড আইনজীবী আপনি একটু দেখেন।
কুকুরের মালিক খায়রুল বাশার যুগান্তরকে বলেন, সম্পূর্ণ সন্ত্রাসী কায়দায় ১৫-২০ উচ্ছৃঙ্খল লোক নিয়ে এসে আমার বাসা থেকে ওরা কুকুর দুটি নিয়ে গেছে। কুকুরের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
তিনি বলেন, আমার কুকুর তো ফেরত দিতেই হবে। পাশাপাশি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে হবে।
জানতে চাইলে পুলিশের ধানমণ্ডি বিভাগের এডিসি আবদুল্লা হিল কাফি যুগান্তরকে বলেন, উভয় পক্ষ শিগগিরই একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে
যুগান্তর