এরা প্রায় সকলেই রাজশাহী নগরীর সনামধন্য পরিবারের সন্তান। এদের ধরতে অভিযান করেন মহানগর ডিবি পুলিশ।

নিজস্ব প্রতিবেদক: মাহি, মুন, সাকিল, জয়, কাফি, ইস্তি এবং প্রান্ত। এগুলো সাতজন ছিনতাইকারীর ডাক নাম। এরা প্রায় সকলেই রাজশাহী নগরীর সনামধন্য পরিবারের সন্তান। যাদের এক কথায় বলা হয় ‘ধনির দুলাল।’ তবে এরা সকলেই রাজশাহী নগরীর চিহ্নিত ছিনতাইকারী। এদের একেকজনের আছে পালসার, এফজেড, ফেজার, জিক্সার বা বাজাজ আটিআর ব্যান্ডের দামি দামি মোটরসাইকেল। এই মোটরসাইকেলগুলোতে চড়ে গোটা রাজশাহী নগরী ঘুরে বেড়াই এরা। সঙ্গে গোটা নগরীর ছিনতাইয়ের নিয়ন্ত্রণও করে এরা। এদের একটি ফেসবুক গ্রুপ আছে। যে গ্রুপের নাম ফালÍু গ্রুপ। এই গ্রুপের মাধ্যমেই গোটা নগরীর ছিনতাইয়ের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এরা। এদের কউে কেউ আবার ছাত্রলীগেরও নেতা।
এদের বাবাদের মধ্যে কেউ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ সরকার দলীয় নেতা, কেউ বিএনপি দলের নেতা, কেউ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী, কেউ বড় ব্যবসায়ী অথবা কেউ সরকারি বড় চাকরিজীবী। অথচ তাদের ছেলেরাই রাজশাহী শহরের তালিকাভূক্ত অন্যতম ছিনতাইকারীরা-এমনই তথ্য দিয়েছে খোদ রাজশাহী মহানগর পুলিশের একাধিক সূত্র।
রাজশাহী মহানগরীতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একের পর এক ছিনতাইয়ের মূল নায়কদের ধরতে পুলিশের অভিযানের মুখে বের হয়ে এসেছে এমন তথ্য। সেই তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে পুলিশ নগরীতে ঘটে যাওয়া ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে অন্তত ৩১ জনের নাম তালিকাভূক্তও করেছে। যাদের মধ্যে রয়েছে সবার শীর্ষে ধনির দুলাল নামে পরিচিত ওপরের ছয়জনের নাম। এদের একেকজনের নামে রয়েছে অন্তত দুটি করে ছিনতাই মামলা। ওই ছয়জনের মধ্যে অন্তত ৪ জনই এখন কারাগারে জীবন-যাপন করছে। সাথে তাদের সহযোগীদের মধ্যে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে আরো অন্তত ১০ জন। আর বাকিরা এখনো চষে বেড়াচ্ছে গোটা রাজশাহী নগরী। পাশাপাশি একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনার জন্ম দিচ্ছে তারা।
জানতে চাইলে রাজশাহী নগর পুলিশের মুখপাত্র ইফতে খায়ের আলম বলেন, ‘ছিনতাইকারীরা বেশিরভাগ সময় নামি-দামি মোটরসাইকেল ব্যবহার করে ছিনতাইকাজে জড়িয়ে পড়ছে। আবার কেউ কেউ ভিন্ন কৌশলে ছিনতাই করছে। তবে আমরা অব্যাহত ছিনতাই রোধে এরই মধ্যে কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। এর মধ্যে নগরীতে তল্লাশি চৌকি বৃদ্ধি করা, ভ্রাম্যমান মোটরসাইকেল টহল জোরদার করা এবং ছিনতাই প্রবন এলাকাগুলোতে টহল জোরদার করা। পাশাপাশি তালিকাভ’ক্ত ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অভিযানও জোরদার করা হেয়ছে।’
জানা গেছে, সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার নগরীর অদূরে হরিয়ান এলাকায় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে রহমান জুটমিলের ১৭ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ডিবি পুলিশের পোশক পরে গাড়ী তল্লাশির নামে ছয়জন ছিনতাইকারী এ ঘটনা ঘটায় বলে রহমান জুটমিলের দুই কর্মকর্তা নয়ন ও পুনম জানান। তারাই টাকাগুলো নিয়ে জুটমিলে যাচ্ছিলেন।
এর তিনদিন আগে গত সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) রাজশাহী নগরীর রানী বাজার এলাকায় ব্যাংকে যাওয়ার সময় ফেরদৌসি বেগম নামের এক নারীর নিকট থেকে চার লাখ ৬০ হাজার টাকা কৌশলে ছিনিয়ে নেয় দুই ছিনতাইকারী। ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ওই টাকা ছিনতাইকারীদের একজনকে ভিডিও ফুটেজে সনাক্ত করা গেলেও গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তার কোনো পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।
এদিকে এ নিয়ে গত ২১ দিনের মধ্যে রাজশাহীতে তিনটি বড় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলো একই কায়দায়। তিনটি ঘটনায় মোট ২৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলো। এছাড়াও ছোট আরো অন্তত ৩০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে এই কয়েকদিনে।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, নগরীতে বর্তমানে ছিনতাইয়ের নিয়ন্ত্রক অন্তত ৩১ জন। এদের মধ্যে ৭ জন হলো মূল হোতা। ছিনতাইকারীরা অধিকাংশই ধনীর দুলাল নামে পরিচিত। অর্থাৎ তাদের বাবারা রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশায় বড় বড় জায়গায় রয়েছেন। কিন্তু তাদের ছেলেরাই নামি-দামি মোটরসাইকেল নিয়ে গোটা নগরী চষে বেড়ায় আর ছিনতাই করে বেড়ায়। বিশেষ করে এদের মূল টার্গেট হলো নারী এবং বাইরে থেকে আসা স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীরা। ছিনতাইকারীরা এদের নিকট থেকে নগদ টাকা, মোবাইল ফোন অথবা স্বর্ণের গহনা ছিনিয়ে নিয়ে থাকে।
পুলিশ ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র মতে, রাজশাহী নগরীতে গত ২০ দিনে অন্তত ৩০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে গত ১৬ আগস্ট রাজশাহী নগরীর পার্ক গেট এলাকায় এবং গত ২ সেপ্টেম্বর রাজশাহী নগরীর রানী বাজার এলাকায়। পার্ক গেটের সামনে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাড়ি ফেরার পথে রাইয়ানা নামের এ নারীর নিকট থেকে সাড়ে চার টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। আর রানী বাজারে ছিনিয়ে নেওয়া হয় ফেরদৌসি বেগম নামের এক নারীর নিকট থেকে চার লাখ ৬০ হাজার টাকা। বড় এই দুটি আলোচিত ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্ত নেমে পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একের পর এক ছিনতাইকারীদের মূলহোতাকে খুঁজে পাই।
এই ছিনতাইকারীদের মধ্যে রয়েছে নগরীর কলাবাগান এলাকার মাহি, হাদির মোড় এলাকার আব্দুল্লাহ হেল কাফি, লক্ষীপুর ভাটাপাড়া এলাকার মুরাদ, বুলনপুর ঘোষপাড়া এলাকার শ্রী সুজন সরকার, চন্ডিপুর এলাকার আকাশ আলী শিমুল ও সনি, নগরীর টনি, হড়গ্রাম পূর্বপাড়া এলাকার আওয়াল, লক্ষীপুর ভাটাপাড়া এলাকার সুজন মিয়া, আলীগঞ্জ আকছানগর এলাকার বাপ্পারাজ, হেতেম খাঁ এলাকার হাফিজুল ইসলাম বাপ্পি, ডাশপুকুর এলাকার রিপন, চন্ডিপুর এলাকার রনি, একই এলাকার আল ছাদ্দাম হোসেন দর্পন, বিলশিমলা বন্ধগেট এলাকার সওদাগার, অচিনতলা এলাকার সিহাব, ভাটাপাড়া এলাকার ইমন, বহরমপুর এলকার ডলার, একই এলাকার মিজু, শেখপাড়া মুক্তাপুকুর এলাকার কাওছার আহমেদ শাকিল, বহরমপুর এলাকার সিজার, তেরোখাদিয়া মধ্যপাড়া এলাকার আবির হোসেন জয়, তেরোখাদিয়া ডাবতলা এলাকার মারুফ, হেতেম খাঁ সবজিপাড়া এলাকার ইশতিয়াক উদ্দিন সরকার ওরফে ইস্তি, ভাটাপাড়া এলাকার সজিব, বহরমপুর এলাকার মামুন, হোসনিগঞ্জ বেতপট্টি এলাকার আব্দুল আল বিশারী ওরফে প্রাণÍ, হড়গ্রাম পুর্বপাড়া এলাকার ইয়াসির আরাফাত, লক্ষীপুর জিপিও এলাকার রিচার্ড, হড়গ্রাম পূর্বপাড়া এলাকার আওয়াল এবং দাশপুকুর এলাকার জামাল শেখের ছেলে রিপন।
এদের প্রত্যেকেই একের অধিক ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। আবার কেউ কেউ ১৭-২০ টি ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃৃক্ত। এদের অনেকের নামেই রয়েছে একের অধিক ছিনতাই মামলা।
পুলিশসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র নিশ্চিত করেছে, এই ছিনতাইকারীদের অধিকাংশই ফেসবুকের ‘ফালÍু গ্রুপ’র সদস্য। নিজেদের মধ্যে ফেসবুকের ওই গ্রুপেই বেশিরভাগ সময় যোগাযোগ রক্ষা করে চলে এরা। আবার ছিনতাইয়ের পর এদের কোনো কোনো দল কখনো বিপদের মুখে পড়লে অন্যরা এসে উদ্ধারেও হাত বাড়ায়। এভাবেই গোটা নগরীর বিভিন্ন স্পটে ছিনতাই কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে এরা। এদের আবার কেউ কেউ ক্ষমতাসিন দল আওয়মাী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগেরও নেতাকর্মী। যাদের মধ্যে একজন রয়েছে একটি ওয়ার্ড শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি। আর ‘ফালÍু গ্রুপ’র সভাপতি হলো, কলাবাগান এলাকার মাহি এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহেল কাফি।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগরীর কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘ছিনতাইকারীদে গ্রেপ্তারের পর বড় ধরনের তদবির আশে। এসব তদবিরের কারণেও নগরীতে বড় মাপের এবং ধনির দুলাল নামে পরিচিত ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে অনেক সময় পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছে না। ফলে নগরীতে ছিনতাইয়ের পরিমাণ রোধ করা যাচ্ছে না।’

Next Post

পাহাড়িদের জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই কেন?

সোম আগস্ট ২০ , ২০১৮
আভা ডেস্ক : শনিবার পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর বাজারে প্রকাশ্য দিবালোকে ব্রাশফায়ারে ৬ জন ও পরে বিক্ষোভে গুলিতে আরেকজন, মোট ৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এতে আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৫ জন। উদ্বেগের বিষয়, হতাহতদের বেশিরভাগই পাহাড়ের বহুধাবিভক্ত আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর কোনো কর্মী-সমর্থক নন, সাধারণ মানুষ। এ নিয়ে সর্বশেষ দশ মাসে পাহাড়ে […]

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links