আজ ১৩ জুন। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক অধ্যায়ের ভয়াল কালো দিন

আভা ডেস্কঃ আজ ১৩ জুন। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক অধ্যায়ের ভয়াল কালো দিন। প্রত্যেক দেশের এবং জাতির জন্মলগ্নে এমন অনেক মর্মান্তিক ঘটনা থাকে, যা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর।

আবার এমন অনেক ঘটনা আছে যা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। অর্থাৎ সেসব ঘটনা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না অথবা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয় না।

অথচ ওইসব ঘটনাবলিকে জাতির জন্ম ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করাও যায় না। যদি তাই হয়, তাহলে সে জাতির ইতিহাসই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ১৩ জুন সৈয়দপুরের ‘গোলাহাট গণহত্যাকাণ্ড’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তেমনই একটি মর্মান্তিক ঘটনা।

আমার বিশ্বাস নতুন প্রজন্ম তো দূরে থাক, আমরা যারা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র ধারক-বাহক হিসেবে নিজেদের দাবি করি এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র স্লোগান তুলে তুলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তারাও ওইদিন কী ঘটেছিল তা সঠিকভাবে বলতে পারব না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা গর্ব করি।

এ রকম একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের মহিমান্বিত করেছে। মর্যাদাবান জাতি হিসেবে আমাদের করেছে প্রতিষ্ঠিত। অথচ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গোলাহাট গণহত্যা, চুকনগর গণহত্যা, জাতিভাঙা গণহত্যাসহ এমন আরও অনেক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সম্পর্কে অজ্ঞ।

যদিও ইদানীং গোলাহাট গণহত্যা নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মাঝেমধ্যে কিছু লেখা চোখে পড়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ দেশের মানুষ নিগৃহীত হয়েছে।

আবার অনেকেই নিজের জীবন বিপন্ন করে লড়াই করেছে দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধে তাদের এ অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। মহান মুক্তিযুদ্ধের আত্মোৎসর্গকারীদের উত্তরসূরি হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত তাদের এই অবিস্মরণীয় অবদানকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করা।

১৯৭১ সালে তৎকালীন নীলফামারী মহকুমার (বর্তমানে জেলা) সৈয়দপুর থানায় (বর্তমানে উপজেলা) মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দুটি জঘন্যতম গণহত্যা সংঘটিত হয়। একটি সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ফার্নেস চুল্লিতে কয়েকশ’ বাঙালিকে ছুড়ে ফেলে পুড়িয়ে ছাই করে মারা, অপরটি ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার নাম করে সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গোলাহাট নামক স্থানে ট্রেনে করে নিয়ে বিহারিদের সহযোগিতায় ৪১৩ জনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে হত্যা করা। ১৩ জুন গোলাহাটে মূলত হিন্দু মাড়োয়ারি ও বাঙালি হিন্দু তরুণ ও যুবকরা এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এ হত্যাকাণ্ডে মূল ভূমিকা পালন করে ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বিহারি জনগোষ্ঠী। পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষ এ গণহত্যার নাম দিয়েছিল, ‘অপারেশন খরচাখাতা’। যদিও এই গণহত্যা ‘গোলাহাট গণহত্যা’ নামে পরিচিত।

সৈয়দপুর ব্রিটিশ শাসনাকাল থেকেই রেলওয়ে শহর ও ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ১৮৭০ সালে ইংরেজ সরকার সৈয়দপুরে একটি রেল কারখানা স্থাপন করলে ব্যবসা ও বাণিজ্যের জন্য এ শহরটি সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তখন থেকেই সৈয়দপুর মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারত বিভাগের পূর্ব থেকেই তারা এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হলেও অনেকেই থেকে যান এবং ব্যবসার পাশাপাশি সমাজের অংশ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের জনহিতকর কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন।

অপরদিকে সৈয়দপুরে রেলওয়ে কারখানা স্থাপন করে ইংরেজরা ভারতের বিহার রাজ্য থেকে প্রায় সাত হাজার বিহারিকে শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসে। এরপর থেকেই সৈয়দপুরে বিহারিদের বসবাস শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগের কারণে ব্রিটিশ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বিহারে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আনুমানিক ৩০ হাজারেরও বেশি বিহারিকে হত্যা করা হয়েছিল। এর ফলে ভারত ভাগের পরবর্তী দুই দশকে প্রায় ১৫ লাখ মুসলিম বিহারি পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার থেকে উদ্বাস্তু হয়ে বর্তমানে রংপুর বিভাগীয় অঞ্চলে চলে আসে। এর মধ্যে অধিকাংশ উর্দুভাষী মুসলমান সৈয়দপুর শহরে এসে বসবাস শুরু করে। যেহেতু এরা উর্দুভাষী, তাই তৎকালীন পাকিস্তান প্রশাসন তাদের সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা ও রেলওয়ে বিভাগে বাঙালির চেয়ে বেশি চাকরি দেয়। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে সৈয়দপুর শহরে প্রায় ৭৫ শতাংশ ছিল বিহারিদের বসবাস।

সৈয়দপুরে সেনানিবাস থাকায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বিহারি নেতাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল বেশি। তখন লে. কর্নেল শফির অধীনে ২৩ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট ও লে. কর্নেল হাকিম এ কোরেশীর অধীনে ২৬ এফএফ রেজিমেন্ট সৈয়দপুর সেনানিবাসে ছিল। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের আগেই ২৩ মার্চ পাকসেনাদের প্ররোচনায় ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিহারিরা প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালিয়ে প্রচুর অর্থ-সম্পদ লুট করে নেয়। শহরের পাড়া-মহল্লার বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করে গণহত্যা চালায় এবং মা-বোনের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। তাদের এই হত্যাযজ্ঞে সৈয়দপুর শহর পরিণত হয় বধ্যভূমিতে। ওইদিন থেকেই সৈয়দপুর শহরে বাঙালিদের কার্যত অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়। এ পরিস্থিতিতে সৈয়দপুর এবং আশপাশের এলাকায় ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সৈয়দপুর ছাড়াও নীলফামারী, দিনাজপুরের খানসামা, চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর এলাকার বাঙালিরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয় এবং হাজার হাজার বাঙালির সমাবেশ ঘটিয়ে সৈয়দপুর শহর ঘেরাও করে অবরুদ্ধ বাঙালিদের উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৪ মার্চ চিরিরবন্দর উপজেলার আলোকদিহি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাহাতাব বেগের নেতৃত্বে আনুমানিক চার থেকে পাঁচ হাজার বাঙালি দেশীয় অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসে। ঘেরাওয়ের প্রথমেই অংশগ্রহণকারী বাঙালিরা পাকসেনা ও বিহারিদের প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়। পাকসেনারা নির্বিচারে বাঙালিদের ওপর গুলি করে। গুলিবিনিময়ের এক পর্যায়ে মাহাতাব বেগ ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। কথিত আছে, নিহত হলে বিহারিরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাহাতাব বেগের মাথাটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং তার দ্বিখণ্ডিত মাথা নিয়ে শহরময় বিজয় উল্লাস করে। ঘেরাওয়ের ঘটনার জের ধরে ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ডা. জিকরুল হক, ডা. সামছুল হক, ডা. বদিউজ্জামান, সৈয়দপুরের ভাসানী ন্যাপের সভাপতি ডা. ইয়াকুব আলী, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তুলসীরাম আগরওয়ালা, রামেশ্বরলাল আগরওয়ালা, কমলা প্রসাদসহ অনেক রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী ও সুধীজনকে পাকসেনারা আটক করে নিয়ে যায় এবং ১২ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাস সংলগ্ন নিসবেতগঞ্জের বালারঘাট বধ্যভূমিতে নিয়ে অন্য আরও ১৫০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হিন্দু ও মাড়োয়ারিদের ভেতর ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই সৈয়দপুর শহরে অবরুদ্ধ বাঙালিরা যেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জার্মানদের তৈরি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দিদের মতো জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। ব্যাপক ধরপাকড়ে বন্দি বাঙালি পরিবারের সদস্যদের মূলত দুটি বন্দি শিবিরে রাখা হয়েছিল। এদের একটি অংশে ছিল বাঙালি সংখ্যালঘু হিন্দু ও মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের কয়েকশ’ পরিবার। সে সময় পাকসেনারা প্রতিদিন আটক বাঙালি ও হিন্দু মাড়োয়ারিদের গাড়িতে করে তুলে নিয়ে সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণ কাজে লাগাত। সারা দিন কাঠফাটা রোদে নবনির্মিত বিমানবন্দরের ইট বিছানোর কাজ শেষে সন্ধ্যায় তাদের আবার ফিরিয়ে আনা হতো। বিমানবন্দরের কাজ যখন একেবারে শেষ পর্যায়ে তখন আটক হিন্দু মাড়োয়ারিদের নিয়ে সেনা কর্তৃপক্ষ এক গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। আগেই উল্লেখ করেছি সৈয়দপুরে বাঙালি নিধনের অসংখ্য ঘটনার মধ্যে ১৩ জুন সংঘটিত ঘটনা ছিল সর্ববৃহৎ লোহহর্ষক গণহত্যা। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় এবং গোলাহাট গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবান ব্যক্তিদের সরাসরি বক্তব্যে জানা যায়, ৫ জুন থেকেই সৈয়দপুর শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মাইকে ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল, সৈয়দপুর শহরে যে ক’জন হিন্দু মাড়োয়ারি আটকা পড়ে আছেন, তাদের সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দেয়া হবে। সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে একটি বিশেষ ট্রেনে করে তাদের চিলাহাটা হয়ে শিলিগুড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। এ ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও সেনা কর্তৃপক্ষ ৬ জুন বাড়িতে বাড়িতে বিহারি রাজাকার পাঠিয়ে শুধু পুরুষদের সৈয়দপুর সেনানিবাসে ডেকে নিয়ে বন্দি করে রাখে। এদের মধ্যে যারা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং ধনী শ্রেণীর ব্যক্তি ছিলেন, পাক কর্তৃপক্ষ তাদের একে একে ব্যাংকে পাঠিয়ে ব্যাংকে গচ্ছিত সব টাকা উঠিয়ে নেয়। ১২ জুন রাতে ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের মেজর জাবেদ ইউনুস আটক বাঙালি হিন্দু ও মাড়োয়ারিদের বলেন, ‘তোমরা পাকিস্তানের জন্য অনেক করেছ। তোমাদের আমরা ক্ষতি করব না। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাদের সবাইকে ভারতে পাঠিয়ে দেব।’ মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচারে জর্জরিত আটক এসব ব্যক্তি মেজর জাবেদের মিষ্টি কথায় যেন কিছুটা আশার আলো দেখতে পান। তাদের মানসিক অবস্থা এমন হয়েছে যে, এখন যেন ভারতে চলে যেতে পারলেই বাঁচেন। এ কারণে তারা এক কথায় রাজি হয়ে মেজর জাবেদকে অনুরোধ করেন, পরিবারের সদস্যদেরও যেন তাদের সঙ্গে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। মেজর জাবেদ সানন্দে তাদের অনুরোধে রাজি হয়ে যায় এবং ঠোঁটের কোণায় এক বিকৃত হাসি হেসে সবাইকে ওপারে পাঠানোর সুব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বস্ত করেন। আটক মানুষগুলো তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি, মেজর জাবেদের ওই রহস্যময় হাসির আড়ালে কী ভয়াবহ পরিণতি লুকিয়ে আছে।

১৩ জুন খুব ভোরে সেনানিবাসে আটক হিন্দু মাড়োয়ারিদের বাসে করে সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। অপরদিকে অন্য কয়েকটি বাসে তাদের পরিবারের সদস্য ও অন্যান্য বাঙালি হিন্দুকে স্টেশনে নিয়ে আসে। স্টেশনে আসার পর পর পাকিস্তানি সৈন্যরা জোর করে ১৮ সুন্দরী তরুণী ও মহিলাকে বাছাই করে আলাদা করে ফেলে এবং তাদের গাড়িতে করে সৈয়দপুর সেনানিবাসে পাঠিয়ে দেয়। ততক্ষণে চার বগির একটি বিশেষ ট্রেন বাকি সবার জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে সামনের দুটো বগিতে পুরুষদের তোলা হয় এবং পরের দুই বগিতে মহিলা ও শিশুদের তোলা হয়। যাত্রীর সংখ্যা মোট ৪৩৬। যাত্রীরা ট্রেনে ওঠার পরপর বগির সব দরজা ও জালানা বন্ধ করে দেয়া হয়। অতঃপর সকাল আনুমানিক ৭টায় চিলাহাটার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে ট্রেনটি। খুব ধীরগতিতে চলতে চলতে স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গোলাহাটের বর্তমান লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে এসে ট্রেনটি থেমে যায়। ট্রেন থামার কারণ জানার জন্য যাত্রীরা জানালা ফাঁক দিয়ে তাকাতেই অস্পষ্ট আলোতে দেখতে পান, অসংখ্য পাকিস্তান সেনাসদস্য ও বিহারি পুলিশ রেললাইনের দু’দিকেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে মুখে কাপড় বাঁধা একদল বিহারি। তাদের কারও হাতে তলোয়ার, কারও হাতে রামদা কিংবা তীক্ষ্ণ ধারালো ছুরি। এর পরই শুরু হয় মানবতার ইতিহাসের বিশ্বাসঘাতকতার এক জঘন্যতম এপিসোড; শুরু হয় হত্যার উৎসব। ট্রেন থামার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রধারী বিহারিরা প্রতিটি কামরায় ঢুকে একে একে সবাইকে নামিয়ে রামদা ও ছুরি দিয়ে জবাই করা শুরু করে। ট্রেনের ভেতর শুরু হয় বুক ফাটা আর্তনাদ। মহিলাদের করা হয় নির্মম নির্যাতন, এবং অবুঝ শিশুদের পায়ে ধরে ধোপার কাপড় কাচার মতো করে রেললাইনের ওপর আঘাত করে করে মাথা থেঁতলে দেয়া হয়। তলোয়ারের আঘাতে আঘাতে কচুকাটা করে এক একজনকে। কখনও যুবক, কখনও বৃদ্ধ, কখনও বা মহিলা এবং শিশুর চিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে নির্জন গোলাহাটের বাতাস। প্রাণ বাঁচাতে কাতর নারী-পুরুষের নিষ্ফল আর্তনাদ তলোয়ার এবং রামদার এক একটি আঘাতে নিস্তব্ধ হয়ে যায়।

এরূপ পরিস্থিতিতে অনেকেই বগির জানালা ভেঙে লাফিয়ে পড়ে দৌড়ে প্রাণ বাঁচাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। কিন্তু পাকসেনাদের আগে থেকেই পজিশনে রাখা মেশিনগানের বিরামহীন গুলিবর্ষণে মাটিতে আছড়ে পড়তে থাকেন একে একে। সে এক লোমহর্ষক দৃশ্য। ভোরের রক্তাভ আলোয় দৃশ্যমান এ ঘটনা যেন বিশ্বমানবতাকেই ভূলুণ্ঠিত করে। এতসব ঘটনার মাঝে দৈবক্রমে বেঁচে যান বিনত বাবু, রামলাল দাস, গোবিন্দ চন্দ্র দাস, তপনকুমার দাসসহ আরও ২৩ ভাগ্যবান পুরুষ। এভাবেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে মোট ৪৩৬ জনের মধ্যে ৪১৩ জন হতভাগ্য হিন্দু মাড়োয়ারিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বিশ্বাসঘাতকতার এক চূড়ান্ত উদাহরণ সৃষ্টি করে, যা শুধু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সঙ্গেই তুলনীয়।

প্রাণে বেঁচে যাওয়া বিনত বাবু, গোবিন্দ্র চন্দ্র দাসের মতো মানুষ সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে আজও বেঁচে আছেন। কর্মস্থলের সুবাদে তাদের দু-একজনের সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ এ মানুষগুলো সেদিনের সেই ভয়াল স্মৃতি মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। যেন সেদিনের সেই আতঙ্ক আজও তাদের তাড়া করে ফেরে। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরও গোলাহাট বধ্যভূমি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় মনে কষ্ট নিয়ে তারা এতদিন ঘুরে বেড়িয়েছেন। এ ব্যাপারে সরকারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। কর্মসূত্রে যখন রংপুরে ছিলাম, তখন আমিও সশরীরে গোলাহাট বধ্যভূমি দেখে অবাক হয়েছি। দেরিতে হলেও বর্তমানে বেসরকারি উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়েছে। বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে এ রকম অনেক বধ্যভূমি আছে, যা অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে। এসব অরক্ষিত বধ্যভূমি সংরক্ষণের আশু ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

২০১৭ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শেখ মিজানুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, সরকার সমগ্র বাংলাদেশে ২৭৯টি বধ্যভূমি সংরক্ষণে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ৩৫০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। ২০১৮ সালের জুন নাগাদ প্রকল্প কাজ সম্পন্ন হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন। সরকারের এ উদ্যোগকে সবাই তখন সাধুবাদ জানিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রকল্পের কতটুকু অগ্রগতি বা বাস্তবায়ন হয়েছে, তার কোনো খবর আমরা সংবাদমাধ্যমগুলোয় দেখতে পাইনি। দেশের জন্য আত্মত্যাগকারী মহান ব্যক্তিদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের জন্য যেমন স্মৃতিফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা উচিত, তেমনই নতুন প্রজন্মকে এ দেশের লাখো শহীদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ ও গৌরবগাথা জানানোর জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক শিক্ষা সূচিতে এসব স্থান পরিদর্শনের জন্য বিশেষ সফর কর্মসূচিও অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।

একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

যুগান্তর

Next Post

কমলাপুর , চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ বিভিন্ন স্টেশনেও ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রেলের ‘ভয়ানক’ কাজ করছে শিশুরা।

বৃহস্পতি জুন ১৩ , ২০১৯
আভা ডেস্কঃ কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে মাদকাসক্ত শিশুদের দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করাচ্ছেন দায়িত্বরত কর্মচারীরা। আন্তঃনগর, মেইল কিংবা লোকাল ট্রেনের ইঞ্জিন খোলা ও লাগানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি বছরের পর বছর করছে ছিন্নমূল শিশু-কিশোররা। কাজটি কার, কে করছে তা দেখারও কেউ নেই। যৎসামান্য টাকার বিনিময়ে শিশুদের দিয়ে কাজগুলো করিয়ে বসে বসে বেতন […]

এই রকম আরও খবর

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links