আভা ডেস্কঃ রাজশাহী অঞ্চলজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে হুন্ডির ব্যবসা। প্রতিদিনই অন্তত শত কোটি টাকা পাচার হচ্ছে এই হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধ পথে। এটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থাসহ প্রশাসনের সবস্তরেই জানা। কিন্তু এই হুন্ডির নেপথ্যের নায়কদের নিয়ে কিছু তথ্য আসে কালের হাতে। এই তথ্য খুঁজতে গিয়ে একটি টিম নামে রাজশাহী অঞ্চলসহ দেশের আরও কয়েকটি এলাকায়। আর তাতেই একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে হুন্ডি মাফিয়াদের নিয়ে গড়ে ওঠা হুন্ডি সম্রাজ্যের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
এই মাফিরা ভারত থেকে পেঁয়াজ ও পাথর আমদানিসহ গরু চোরচালানের মাধ্যমে বিদেশে কোটি কোটি টাকা পাচার করছে। কখনো নগদ টাকা, আবার কখনো স্বর্নের বার পাচারও করছে তারা। সেই সঙ্গে পাথর ও পেঁয়াজের মধ্যে অবৈধভাবে বিদেশি অস্ত্র ও, হেরোইন, বিদেশি অস্ত্র ও বিস্ফোরক আসছে। আর সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশের অভ্যান্তরে। পাথর আমদানির নামে অবৈধ পণ্য চোরাচালান ও অর্থ পাচার মূখ্য হওয়ায় সেই পাথর দেশের বাজারের অন্যান্য কম্পানীর চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি করতে পারছে এই চক্রটি।
অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই জাল বিস্তারের কার্যক্রমে জড়িত চক্রের সন্ধান পায়। সেই তালিকার সঙ্গে গোয়েন্দাদের করা তালিকাতেও উঠে আসে এমনসব তথ্য ও হোতাদের নাম। যেটি ধরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে আরও নানাসব তথ্য।
অনুসন্ধান করে পাওয়া গেছে, হুন্ডি ব্যবসার মূল চক্রের হোতা হলেন ভারতীয় একটি মাফিয়া গ্রুপ। এই গ্রুপের হোতা জাহাঙ্গীর আলম, হুমায়ন ও মেহেদী হাসানসহ তাদের মামা গ্রেপ্তারকৃত এনামুল হকের ছত্রছায়ায় ভারতসহ বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে হন্ডি, মাদক ও অবৈধ অস্ত্র পাচারের একটি বিশাল নেওয়ার্ক। সেই নেটওয়ার্কে জড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের রাজশাহী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের একেকজন কিভাবে শূন্য থেকে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন সেসব তথ্যও উঠে আসে বিশেষ অনুসন্ধানে।
ভারতীয় হুন্ডি চক্রের হোতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশের মাফিয়ারাও বিপুল সম্পদের মালিক। অথচ এই তারাই কয়েক বছর আগেও ছিলেন কেউ মুদির দোকানদার, দিনমজুর, আবার কেউ শ্রমিক শ্রেণির। আমদানি-রপ্তানীর আড়ালে কালোবাজারির ব্যবসায় জড়িয়ে তারা গত ৫-৭ বছরের মধ্যে হয়েছেন কোটি কোটি টাকা ও সম্পদের মালিক। তারা কেউ ঘুরেন বিমএডাব্লিুউ, প্রাডো, লেক্সাস, হ্যারিয়ারসহ বিলাশবহুল গাড়িতে। থাকেন একেকজন যেন রাজ-প্রাশাদে।
অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে, এসব অপককর্ম করতে গিয়ে এই চক্রটি সরকারের একাধিক উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গেও গড়ে তুলে সখ্যতা। পাশাপাশি মিডিয়া জগতে নাটক ও সিনেমা নির্মাণের নামে জাল ফেলেছে তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশের অভ্যান্তরে হুন্ডি, মাদক, গরু চোরাচালান ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করে গ্রুপটি। তাদের হাত ধরেই গড়ে উঠেছে রাজশাহী অঞ্চলজুড়ে একটি বিশাল সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের হোতারা ভারত ও দুবাই থেকে পাথর আমদানী, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি, গরু, মাদক এবং অস্ত্রচোরাচালানের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা পাচার করছে বিদেশে। অবৈধ পণ্যের মূল্য পরিশোধের জন্য হুন্ডির মাধ্যমে নগদ অর্থ ও স্বর্ণের বার বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হচ্ছে।
সূত্র মতে, চলতি মাসে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অন্তত ৫০ কোটি টাকার মাদক উদ্ধার করে। এর মধ্যে কেবল রাজশাহী র্যাবই প্রায় চার কোটি টাকার মাদক উদ্ধার করে। যার সিংহভাগই হলো হেরোইন। যেগুলো এই দুই জেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত হয়ে দেশের অভ্যান্তরে প্রবেশ করেছে। সর্বশেষ গত ২১ আগস্ট র্যাব প্রায় এক কোটি টাকারর হেরোইনসহ গোদাগাড়ী পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হেরোইন সম্রাট মোফাজ্জল হোসেন মোফাকে গ্রেপ্তার করে। এই মোফাও একজন হুন্ডি ব্যবসায়ী।
অন্যদিকে, এলসির মাধ্যমে আমদানি করা পণ্যের অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে বৈধ পথে পাচার করা হচ্ছে নগদ অর্থ। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার ও পণ্যবাহী ট্রাকে অবৈধ মাদক ও অস্ত্র পাচারের বিষয়টি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে বার বার সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানানো হয়েছে। এটি রোধ করতে চাঁপাইনবগঞ্জেররর সোনামসজিদ বন্দরে স্ক্যানার মেশিন বসানোরও উদ্যোগ নেওয়া হয় সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে। কিন্তু অসাধু এই চক্রটির কারণে সেই উদ্যোগ এখনো কার্যকর হচ্ছে না। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এমনসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। যে প্রতিবেদনটি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরেও পাঠানো হয়েছে এখন থেকে অন্তত দুই বছর আগেই।
২০১৮ সালের ২৯ মার্চ পুলিশ হেডকোয়াটর্সের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট শাখার ততৎকালীন অতিরিক্ত ডিআইজি রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে রাজশাহী অঞ্চলজুড়ে গড়ে ওঠা হুন্ডি ও মাদক চোরাকারবারিদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবগত করা হয়। এছাড়াও ২০১৭ সালের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন পরিচালক (যুগ্ম-সচিব) ফরিদ আহম্মদ স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতেও এই চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। কিন্তু তার পরেও থেমে থাকেনি রাজশাহী অঞ্চল দিয়ে ভারত থেকে কখনো বৈধ পণ্য আমদানির কথা বলে অবৈধ্য পণ্য চোরাচালান করে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা ও স্বর্ণের বার পাচারসহ গরু চোরাচালানের ঘটনা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেই মূলত গ্রিণ সিগন্যাল না পেয়ে এই চক্রের প্রভাবশালী হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাঠে নামতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কারণ এই চক্রের সদস্যরা এখন অনেকেই ভিড়ে গেছেন স্থানীয় নেতাদের কাতারে। কেউ কেউ আবার অবৈধ টাকাকে বৈধ করার জন্য নেমেছেন ঠিকাদারী পেশায়।
গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় পাওয়া তথ্য মতে জানা গেছে, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত অঞ্চলজুড়ে যারা হুন্ডি চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন তাদের মধ্যে অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি এখনো সক্রিয়। যাদের অন্যতম হলেন, মখলেছুর রহমান, আলতাব ও শাহজাহান, সন্তোষ কুমার, শেখ কামাল হোসেন, রনক, রাজন, আবিদ হোসেন, শহিদুল, আতিকুর রহমান, জাফর আহম্মেদ, নূপুর সাহা, মোহন কুমার, শফিকুল ইসলাম ঘুটু, আসোক রাম, আক্কাস আলী, রাহাত, নান্নু, টিটি বাবু ও রনি আহম্মেদ, সুমন, আবদুর রাজ্জাক, নুরুল ইসলাম, মাইনুল ইসলাম, আলতাব হোসেন, মাসুদ, মোফাজ্জল হোসেন মোফা, জমির, কাজল, আকতারুজ্জামান, আবদুল মান্নান, মাহবুল, তোজাম্মেল হক, আবু তালেব, জামাল, ইমাইল হোসেন, ইনজামামুল হক, সেলিম রেজা, আহমদ শাহ নজিবুল্লাহ, শহীদুল্লাহ দোলা, মনিরুল ইসলাম মনি, রফিকুল ইসলাম ওরফে রফিক, মিন্টু, আনারুল, গোলাম জাকারিয়া, সাইফুল ইসলাম, সাজু, মোমিনুল হক, মতিউর রহমান, আশরাফুল ইসলাম, এনামুল হক, নূর ইসলাম, আরিফ হোসেন, রাকিব হাজী, সেতাউর রহমান, হারুন অর রশিদ, জাহাঙ্গীর আলম, ফিরোজ ও টিপু সুলতান। এই সিন্ডিকেট সদস্যররাও অনেকেই একই সময় কেউ দিনমজুর, শ্রমিক, হতদরদ্রি পরিবারের সন্তান ছিলেন। কিন্তু হুন্ডির মাধ্যমে তারাও এখন কোটিপতি।
হুন্ডি নিয়ে কাজ করা রাজশাহীর একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘হুুন্ডি প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু অনেকেই বড় ধরনের জাল বিস্তার করে সে অপতৎপরতা এখনো অব্যাহত রেখেছে। এগুলো প্রতিরোধে জোর তৎপরতা দরকার প্রশাসনের।
সূত্র: কালের কণ্ঠ