আভা ডেস্ক: ভাগ্যের চাকা ঘোরার আশা নিয়ে সৌদি আরবে যাওয়া নারীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে ২১টি শর্ত থাকলেও পরে সেগুলোর মধ্যে ১৩টিই মানা হয় না। চাকরিতে যোগদানের আগে ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করা নিয়োগ প্রক্রিয়ার একটি বাধ্যতামূলক অংশ। এতে নিয়োগকর্তা ও শ্রমিক উভয় পক্ষের জন্য শর্ত জুড়ে দেওয়া আছে। একেক দেশের ক্ষেত্রে চুক্তির শর্ত একেক রকম। তবে সৌদি আরবে গৃহকর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্ধারিত এসব শর্ত মানেন না অনেক নিয়োগকর্তা। এমনকি নির্দিষ্ট অঙ্কের বেতনের কথা উল্লেখ থাকে না সেই চুক্তিতে। বিভিন্ন সময়ে সেখান থেকে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে তাতে স্পষ্ট করে লেখা আছে— গৃহকর্মীদের সর্বোচ্চ বেতন ১২০০ রিয়াল ও সর্বনিম্ন ১০০০ রিয়াল। এর ব্যত্যয় হতে পারবে না। অথচ দেশে ফিরে নারী গৃহকর্মীদের অনেকেই অভিযোগ করেন, ৮০০ রিয়ালের মধ্যে ছিল তাদের বেতনের অঙ্ক। যদিও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) বলছে, সব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া দুষ্কর।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা থেকে রিয়াদে গৃহকর্মী নেওয়ার ব্যাপারে সৌদির বেসরকারি এজেন্সির সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা স্বাক্ষর হয়। এই সমঝোতা দুই দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হলেও সরকার তাতে নজরদারি করার কথা বলেছিল। ফলে ৬০ হাজারেরও বেশি নারী গৃহকর্মীর জন্য সৌদি আরবের দুয়ার খুলে যায়। কিন্তু তখনও পুরুষদের কর্মী হিসেবে নিয়োগের ব্যাপারে কোনও সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি কোনও পক্ষ।
২০১৬ সালের আগস্টে পুরুষ কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সাত বছরের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় সৌদির শ্রম ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয়। সৌদি সরকারের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সেখানে তেলের বাজার ছিল নিম্নমুখী। এ কারণে বাংলাদেশিসহ অন্যান্য দেশের কর্মীদের মধ্যে চাকরি হারানোর শঙ্কা দেখা দেয়।
চুক্তিতে নির্দিষ্টভাবে বেতনের কথা উল্লেখ নেই। বেতনের ঘর ফাঁকা রাখা হয়েছে যাতে নিয়োগকর্তার প্রয়োজন অনুযায়ী অঙ্ক বসিয়ে দেওয়া যায়। নিয়োগকর্তার সহযোগিতায় মাসিক বেতন সৌদির স্থানীয় ব্যাংকে গৃহকর্মীর নিজস্ব অ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে অনেকের ক্ষেত্রেই তা হয় না।
এছাড়া গৃহকর্মীদের একাধারে প্রতিদিন কমপক্ষে ৯ ঘণ্টা বিশ্রাম, সপ্তাহে একদিন ছুটি, পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যসম্মত থাকার জায়গা, ভালো খাবার, কাপড় এবং প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। পাশাপাশি গ্রহণযোগ্য অসুস্থতার কারণে গৃহকর্মীকে সবেতনে ছুটি দেওয়া ও তার যাবতীয় চিকিৎসার ব্যয়ভার নিয়োগকর্তার।
এই চুক্তির মেয়াদ দুই বছরে শেষ হওয়ার পর উভয় পক্ষ তা বৃদ্ধি করতে চাইলে গৃহকর্মী নিয়োগকর্তার খরচে পূর্বের চুক্তি অনুযায়ী ৩০ দিনের সবেতন ছুটিতে দেশে ফিরে যাবেন। যদি কোনও অজ্ঞাত কারণে গৃহকর্মী কাজে অনুপস্থিত থাকে তাহলে নিয়োগকর্তাকে সৌদির রিক্রুটিং এজেন্সিকে জানাতে হবে। পরে রিক্রুটিং এজেন্সি তা বাংলাদেশ দূতাবাসকে অবহিত করবে।
নিয়ম অনুযায়ী গৃহকর্মীর কাছে পাসপোর্ট ও আকামা (ওয়ার্ক পারমিট) থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও দেশে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের অনেকেই বলেছেন, তাদের কাছে তা নেই। সবার সঙ্গেই কথা বলে জানা যায়, কেউই পাসপোর্ট সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারেননি। তাদেরকে সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আউটপাস দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী স্বাধীনভাবে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়ার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। কিন্তু দেশে ফিরে অনেকের অভিযোগ, পরিবারের সঙ্গে ফোননে কথা বলতে চাইলে তাদেরকে মারধর করা হয়।
গত ১৯ মে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন ৬৬ জন নারী শ্রমিক। বিমানবন্দরের প্রবাস কল্যাণ ডেস্ক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ মে ৩৫ জন, ১২ মে ২৭ জন, ১৯ মে ৬৬ জন, ২৩ মে ২১ জন, ২৭ মে ৪০ জন ও ৩ জুন ২৯ জন নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে ১২০ জনের নামে করা আবেদনের ভিত্তিতে বিভিন্ন সময়ে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ৮০ জন নারী শ্রমিককে। ৩ জুন রাতে ফেরত আসা ২৯ জন নারী শ্রমিকের মধ্যে ৪ জন ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আসতে পেরেছেন।
৩ জুন রাতে এয়ার অ্যারাবিয়ার একটি ফ্লাইটে দেশে ফিরে আসা ২৯ জন নারীর মধ্যে আছেন নার্গিস আক্তার (ছদ্মনাম)। ফিরে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, ৯ মাস আগে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে সাড়ে চার মাস কেটেছে সফর জেলেই।
নার্গিসের অভিযোগ, তাকে খাবার দেওয়া হয়নি ঠিকমতো। পাননি বেতনও। দেশে কথা বলতে চাইলে মারতো তার কফিল (নিয়োগকর্তা)। তিনি বলেন, ‘খাইতে দেয় না, বেতন দেয় না। এগুলার কথা জিগাইলেই মারে। দেশে কথা বলতে চাইলেও মারে। পাসপোর্ট মালিক রাইখা দিসে। বেতনও দেয় নাই, খালি হাতে আসছি। আপনাদের কাছে অনুরোধ, যদি পারেন মেয়েদের সৌদি পাঠানো বন্ধ করেন।’
প্রায় একই অভিযোগ করলেন শরিফা (ছদ্মনাম)।সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় পাঁচ মাস আগে কাজের সন্ধানে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে গিয়ে তার স্বপ্নের প্রদীপ গেলো নিভে। চুক্তিতে ১০০০ রিয়াল বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও তার বেতন ছিল ৮০০ রিয়াল। শরিফা জানান, তিনি দেশে ফিরেছেন শূন্য হাতে। এক টাকাও বেতন পাননি।
সৌদি থেকে ফেরত নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেদ্দার সফর জেলে তাদের মতো কয়েকশ’ বাংলাদেশি নারী দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ২-৩ বছর ধরেও আছেন সেখানে। কারণ কফিল তাদের নামে মামলা করেছে। এর নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দেশে ফিরতে পারবেন না তারা।
অন্যদিকে নারী শ্রমিকরা জানিয়েছেন, প্রতিদিনই রিয়াদ ও জেদ্দার সেফ হোমে ২-৩ জন করে আশ্রয় নিতে আসেন। এখনও জেদ্দার সেফ হোমে প্রায় ১০০ নারী আছেন বলে জানালেন তারা। তাদের মধ্যে অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এ কারণে একজন দেশে ফেরার জন্য আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে চেয়েছিলেন বলে জানা যায়।
এমনই একজন মনোয়ারা। দীর্ঘ আড়াই বছর রিয়াদে ছিলেন তিনি। ৩ জুন রাতেই বাকি ২৮ জনের সঙ্গে দেশে ফিরেছেন এই নারী শ্রমিক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনেক অত্যাচার করতো কফিল। সেখান থেইকা পালায় দূতাবাসে আশ্রয় নিসি। ১১ মাসের বেতন পাই, রাইখা আইসা পরসি। দেশে আসার আগে সফর জেলে ছিলাম ১ সপ্তাহ।’
তবে এসব অভিযোগ পুরোপুরি উড়িয়ে দিলেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান। সঠিক জায়গায় বিষয়টি অবহিত করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এসব অভিযোগ নিয়ে কেউ আসে না। এসব অভিযোগ নির্দিষ্ট জায়গায় গেলে সমাধান সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায়। বেতন না দেওয়ার অভিযোগ দিয়েছিল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তাকে তথ্য প্রমাণ এনে দেখালাম। তাই সব অভিযোগের সত্যতা বলা মুশকিল।’
বায়রা’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, ‘বেতনের ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে যে সমঝোতা হয়েছে সেখানে স্পষ্ট লেখা আছে তা। সর্বোচ্চ বেতন ১২০০ রিয়াল ও সর্বনিম্ন ১০০০ রিয়াল। এর নিচে কেউ দিতে পারবে না। যারা অভিযোগ করে তাদেরকে জায়গামতো সেই বিষয় জানাতে হবে। তাহলেই সমাধান মিলবে।’
দারিদ্র বিমোচন ও কর্মক্ষেত্রে স্বল্পতার কারণে অভিবাসন ব্যবস্থা বেছে নেন নারীরা। নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান সুদূর সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবাননসহ বিশ্বের ১৮টি দেশে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে অভিবাসী নারীর সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ১৯ হাজার ৯২৫ জন। যা মোট অভিবাসন সংখ্যার ১৩ শতাংশ। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি এটাই।
১৯৯১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত অভিবাসন প্রত্যাশী নারী শ্রমিককে অভিবাসনে বাধা দেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে ২০০৩ ও ২০০৬ সালে তা কিছুটা শিথিল করা হয়। ২০০৪ সালের পর থেকে ২০১৩ পর্যন্ত নারী শ্রমিকের অভিবাসন হার ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় মোট অভিবাসনের ১৯ শতাংশে। কিন্তু এই হার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।
বাংলা ট্রিবিউন