আভা ডেস্ক: মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে মুক্তমনা লেখক ও বিশাখা প্রকাশনীর মালিক শাহজাহান বাচ্চুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় ইফতারের আগমুহূর্তে উপজেলার মধ্যপাড়া ইউনিয়নের কাকালদী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
নিহত শাহজাহান বাচ্চু জেলা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের বিক্রমপুর’ নামের একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। বিভিন্ন ব্লগেও লেখালেখি করতেন তিনি। তাঁর গ্রামের বাড়ি সিরাজদিখান উপজেলার কাকালদী গ্রামে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সিরাজদিখান সার্কেল) আসাদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শাহজাহান বাচ্চু মুন্সীগঞ্জ-শ্রীনগর সড়কের পূর্ব কাকালদীর তিন রাস্তার মোড়ে আনোয়ার হোসেনের ওষুধের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এ সময় দুটি মোটরসাইকেলে চারজন লোক এসে তাঁকে ধরে রাস্তায় নিয়ে ককটেল ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর বুকের ডান পাশে গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যায় ওই মোটরসাইকেল আরোহীরা। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।
ঘটনার সময় ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন সিরাজদিখান থানার এএসআই মাসুম। তিনি জানান, ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগে একটি বিকট আওয়াজ শুনতে পান। সামনে এগিয়ে দেখেন একজন লোক রাস্তায় পড়ে আছে। এ সময় তাঁকে উদ্দেশ করে কারা যেন বলছে, শালাকে গুলি কর। তখন একজন ব্যাগ থেকে একটি ককটেল ছুড়ে তাঁর দিকে এগিয়ে এলে তিনি দৌড়ে পিছিয়ে যান। তখন তিনি (এএসআই মাসুদ) পিস্তল বের করতেই হামলাকারীদের আরেকজন তাঁকে
উদ্দেশ করে গুলি ছোড়ে। তিনি বসে গুলি করার চেষ্টা করলে বিপরীত রাস্তা দিয়ে সন্ত্রাসীরা মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায়।
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বাচ্চুকে সিরাজদিখান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত শাহজাহান বাচ্চুর এক ভাতিজা (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) বলেন, ‘চাচা ব্লগে লেখালেখি করতেন। মৌলবাদীরা তাঁকে প্রতিনিয়ত হুমকি-ধমকি দিত। আজকেও (গতকাল) আমার দোকানে বসা ছিলেন বিকেল ৩টা পর্যন্ত। মাগরিবের আজানের কিছুক্ষণ আগে খবর পেলাম, আমার চাচাকে কারা যেন গুলি করে হত্যা করেছে। পরে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে শুনি চাচা আর নেই। সিরাজদিখান থানার এএসআই মাসুম আলী ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।’
সিরাজদিখান থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘দুর্বৃত্তদের গুলিতে শাহজাহান বাচ্চু নিহত হয়েছেন। দোষীদের আমরা গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছি। ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।’
নিহত শাহজাহান বাচ্চুর মেয়ে আঁচল জাহান জানায়, তার বাবা একজন ব্লগার ছিলেন। তিন বছর ধরে তিনি গ্রামের বাড়িতে বসবাস করছেন। সদ্য এসএসসি পাস করা আঁচল আরো জানায়, তার বাবার দুই স্ত্রী। সে দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। তার আরেক মা ও দুই বোন ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে থাকে। গ্রামের বাড়িতে বাবার সঙ্গে তার মা, সে এবং নবম শ্রেণিতে পড়া ভাই বিশাল থাকে। আঁচল জানায়, তার বড় বোন দূর্বা জাহান বাবার বিশাখা প্রকাশনী চালান। অন্য বোন বিপাশা জাহানের বিয়ে হয়েছে। আঁচল আরো জানায়, একসময় যখন ব্লগারদের হত্যা করা হচ্ছিল তখন তার বাবার নাম ১১ নম্বর লিস্টে ছিল। তার বাবাকে নিয়মিত হত্যার হুমকি দেওয়া হতো মুঠোফোনে।
শাহজাহান বাচ্চুর বড় মেয়ে দূর্বা জাহান তাঁর ফেসবুক পোস্টে লেখেন—‘আমার বাবা শাহজাহান বাচ্চু আজকে মরে গেছেন। আমাদের গ্রামে। বাবাকে কারা যেন দুইটা গুলি করে মেরে ফেলেছে।’
‘আমাদের বিক্রমপুর’ নামের একটি অনিয়মিত সাপ্তাহিক পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন বাচ্চু।
মুন্সীগঞ্জ থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক বিক্রমপুর চিত্র’ পত্রিকার সম্পাদক অ্যাডভোকেট ব ম শামীম তাঁর ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে জানিয়েছেন, শাহজাহান বাচ্চু কবিতা ভালোবাসতেন। তিনি দীর্ঘদিন জাপানে কাটিয়েছেন। প্রবাসের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন বিশাখা প্রকাশনী। তিনি এতটাই কবিতাপ্রিয় মানুষ ছিলেন যে নিজ অর্থায়নে অনেক কবির বই প্রকাশ করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাবেক সভাপতি মাজহারুল ইসলাম বলেন, বাংলাবাজারের প্রকাশনা সংস্থা বিশাখা প্রকাশনী নিয়মিতভাবে কবিতার বই বের করত। প্রকাশনাটি নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহার মতো প্রখ্যাত কবিদের কাব্যগ্রন্থ বের করত। প্রকাশক হিসেবে সজ্জন ছিলেন বাচ্চু।
কে বা কারা এবং কী কারণে বাচ্চুকে গুলি করে হত্যা করেছে, তা তাৎক্ষণিক পুলিশ ও পরিবার সূত্র জানাতে পারেনি। হত্যার কারণ উদ্ঘাটনে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জঙ্গিদের কোনো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) একটি টিম রাতেই ঢাকা থেকে ঘটনাস্থলে গেছে। তবে তারাও এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পায়নি। বেশ কয়েকটি কারণ সামনে রেখে ঘটনার তদন্ত চলছে বলে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্র জানিয়েছে। সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে জঙ্গি হামলার বিষয়টি তদন্তে গুরুত্ব পাচ্ছে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, কারো সঙ্গে পূর্বশত্রুতাও তদন্তে গুরুত্ব পাচ্ছে।
স্থানীয় সুধীসমাজের মত, ধর্মীয় চেতনার কারণে বাচ্চুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে কি না, তা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখতে হবে।
গত রাতেই ঢাকা থেকে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন সিরাজদিখানে এসেছেন। তিনি সিরাজদিখান থানায় জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও নিহতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন। তিনি প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গেও কথা বলেন। পরে তিনি মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম পিপিএম (বার)সহ রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে সিরাজদিখান থানায় একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। নিহতের স্ত্রীর এ মামলার বাদী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার জানান, এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। কী কারণে তাঁকে হত্যা করা হতে পারে সে সম্পর্কে পুলিশ নিশ্চিত নয়। তবে তিনটি বিষয়ের ওপর পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। কালের কণ্ঠ