একবিংশ শতাব্দীর ঠিক এই সময়ে পুরো পৃথিবীতেই ‘ড্রোন’ অত্যন্ত আলোচিত একটি শব্দ। বর্তমানে প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত নানা কাজে ড্রোনের নানাবিধ ব্যবহার লক্ষণীয়। বাংলাদেশেও প্রতিরক্ষাসহ নিরাপত্তাজনিত নানা কাজে সার্থকতার সাথে ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। আজকের লেখায় থাকছে ড্রোন সম্পর্কিত নানা প্রসঙ্গ।
ড্রোন কী?
ড্রোন হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের মানবহীন পাখিসদৃশ যন্ত্রবিশেষ (Unmanned Aerial Vehicle) যাকে সংক্ষেপে UAV বলা হয়। হেলিকপ্টার বা এই জাতীয় অন্যান্য গগণচারী যানের সাথে ড্রোনের মূল পার্থক্য হচ্ছে, হেলিকপ্টার বা এই জাতীয় কোনো যান চালানোর জন্য এক বা একাধিক মানুষের প্রয়োজন হলেও ড্রোন চালানোর জন্য কোনো মানুষের দরকার হয় না। দূর থেকেই তারহীন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে অথবা আগে থেকে নির্ধারিত প্রোগ্রামিং দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ড্রোনের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ
ড্রোন শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ খোঁজার চেষ্টা করলে মূলত দু’টি অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। ১ম অর্থটি হচ্ছে, চক্রাকারে ঘূর্ণনরত এমন কোনো যন্ত্র যা থেকে খুবই স্বল্পমাত্রার ‘অবিরাম গুঞ্জন’ সৃষ্টি হয়। ২য় অর্থটি বেশ মজার! ড্রোন শব্দটি ব্যুৎপত্তিগত অন্য অর্থে পুরুষ মৌমাছিকে নির্দেশ করে। আমরা সবাই জানি যে, মধু সংগ্রহের বিষয়টি মূলত রানী মৌমাছিই করে থাকে। রানী মৌমাছিকে নিষিক্ত করার কাজ ব্যতীত পুরুষ মৌমাছির আদতে তেমন আর কোনো কাজ নেই। কাজেই, ড্রোন শব্দটির এই বিশেষ অর্থটির মধ্যে কিন্তু দোষের কিছু নেই।
সহজ কথায়, ড্রোন হচ্ছে উড়তে সক্ষম একটি বিশেষ ধরণের রোবট বিশেষ যা দূর থেকে আধুনিক সফটওয়্যারগত প্রোগ্রাম দিয়ে সহজে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই নিয়ন্ত্রণসহ আরও বহুমুখী কাজ করার জন্য ড্রোনে নানা রকম সেন্সর ব্যবহার করা হয়।
ড্রোনের ইতিহাস
আজকের আধুনিক যেসব ড্রোন দেখা যায় তা কিন্তু রাতারাতি তৈরি হয়নি। ড্রোনের সাথে মিলিটারি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কয়েক যুগ সম্পর্ক রয়েছে। মিলিটারি ব্যবস্থায় যেখানে মানুষের কাছে পৌঁছানো দুর্গম এমন সব স্থানে ‘মনুষ্যবিহীন বিশেষ সুবিধা’র জন্য প্রথম দিকে ড্রোনের চিন্তাভাবনা করা হয়। বিগত শতাব্দীর ৩য় দশকের দিকে পুনঃব্যবহারযোগ্য রেডিও ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হলে আকাশযানে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক রাতারাতি পরিবর্তন আসে। পরবর্তীতে সামরিক বিভাগে ব্যবহারের জন্য ‘ক্লাসিক ক্যামেরা এবং সেন্সরসমৃদ্ধ’ ১ম মিলিটারি ড্রোন তৈরি করা হয়।
আধুনিক প্রযুক্তির উত্তরণের সাথে সাথে এখন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন কোম্পানি ড্রোন নির্মাণ করছে। বর্তমানে গুগল, অ্যামাজনের মতো বড় বড় কোম্পানি পণ্য পরিবহণ, যোগাযোগ রক্ষা, তথ্য পরিবহণসহ নানা কাজে সার্থকতার সাথে ড্রোনকে কাজে লাগাচ্ছে। ফেসবুক আজ ড্রোনের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ‘ইন্টারনেট সেবা’ পৌঁছে দিচ্ছে। মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়ও আজকাল ড্রোন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ড্রোন কিভাবে কাজ করে?
আপাতদৃষ্টিতে ড্রোন পরিচালনা ব্যবস্থাকে অত্যন্ত সহজ বলে মনে হলেও বিষয়টি কিন্তু একটু কঠিনই বটে। বস্তুত, আধুনিক ড্রোনের নির্মাণ এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি আধুনিক প্রযুক্তি পরস্পর সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে থাকে।
ড্রোনের ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রযুক্তিটি কাজ করে থাকে তা হলো, মাল্টি প্রোপেলার ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাপনার কারণেই ড্রোন কোনো ব্যর্থতা ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে উড়তে সক্ষম। মাল্টি প্রোপেলার ব্যবস্থা হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থাপনা যেখানে কোনো মোটর হঠাৎ অকার্যকর হয়ে পড়লেও একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা কৌশলের কারণে উড়তে থাকা ড্রোনটিকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনা সক্ষম। এক্ষেত্রে প্রোপেলারের অন্যান্য বিভাগ সার্বিক সমন্বয়ের কাজটি করে থাকে। যেসব ড্রোনে অধিক সংখ্যক মোটর ব্যবহৃত হয়, সেই ড্রোনগুলো সাধারণত উড্ডয়নের ক্ষেত্রে পুরো মাত্রার নিয়ন্ত্রণ এবং উড্ডয়নকালে বেশি মালামাল পরিবহণে সক্ষম। ড্রোনের ক্ষেত্রে সাধারণত শক্তির একটি নির্দিষ্ট উৎস থাকে এবং এক্ষেত্রে পরিবর্তনযোগ্য ব্যাটারি ব্যবহৃত হয়। ঠিক এই কারণে ড্রোন স্বাধীনভাবে দীর্ঘসময় আকাশে উড়তে সক্ষম। বর্তমান সময়ে ড্রোনের নির্মাণ নকশায় এমন পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে ড্রোন আরও দীর্ঘসময় আকাশে উড়তে পারে।
ড্রোনের আন্তর্জাতিক বাজার
বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ড্রোনের ব্যবহার বিস্ময়করভাবে বেড়েছে। বর্তমানে পুরো পৃথিবীতে ড্রোনের বাজার ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের! বর্তমান অগ্রগতির সূচক বিশ্লেষণ সাপেক্ষে ২০২০ সালের দিকে এই বাজার ১২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ২০১৭ সালের আগস্টে ফেডারেল অ্যাভিয়েশন বিভাগের হিসাবমতে, প্রায় ৮০০০০ নিবন্ধিত ড্রোন রয়েছে। ২০২১ সালের দিকে এই সংখ্যাটি ৪২০,০০০ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে সাফল্যের সাথে ড্রোন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন কোর্স চালু করা হয়েছে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, ড্রোন ব্যবস্থাটিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের ‘জাতীয় নিরাপত্তার অংশ’ হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছে।
ড্রোনের সুবিধাসমূহ
সামরিক, প্রতিরক্ষা, শিল্পসহ নানা ক্ষেত্রে সার্থকতার সাথে বর্তমানে ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। এ প্রসংগে নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্টার রিভার ইনকরপোরেটেড প্রধান জেমস এ অ্যাচিভেদো বলেন–
বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় পরিসরগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ‘ত্রুটি এবং ভঙ্গুরতা’ নির্ণয়ে ড্রোন সার্থকতার সাথে ব্যবহৃত হচ্ছে। আগে টুডি (2D) প্রযুক্তিতে কোনো বিষয় যেমনভাবে দেখা হতো বর্তমানে থ্রিডি (3D) প্রযুক্তিতে তার চেয়ে অনেক বেশি মানসম্মত এবং যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে ড্রোনের কাজ ঠিক গড’স আই এর মতোই। মানুষের যেক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার সীমিত বা একেবারেই সম্ভব নয়, সেইসব স্থানে ড্রোন পৌঁছে যাচ্ছে নিমিষে।
পেরিমিটার, পার্কিং লট, জেলখানা, কলেজ ক্যাম্পাস, স্টেডিয়াম নিরাপত্তাসহ বাইরের বিভিন্ন স্থাপনা সুরক্ষায় বর্তমানে সার্থকতার সাথে ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ড্রোনে ব্যবহৃত ‘থার্মাল ইমেজিং প্রযুক্তি’ রাতের বেলায়ও নিরাপত্তা প্রদান করছে।
বর্তমানে বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা তাদের অফিস থেকেই বিভিন্ন ভবনের ছাদ এবং অন্যান্য উঁচু ভবন ড্রোনের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ নজরদারির আওতায় রাখছেন।
কার্যনির্বাহী নিরাপত্তা
জেমস এ অ্যাচিভেদো’র ভাষ্যমতে-
আপনি যদি কোনো কার্যনির্বাহী নিরাপত্তা দলের অংশ হয়ে থাকেন তাহলে দেখবেন যে বিভিন্ন রুট নির্ণয়, যেকোন ধরনের সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং বাধা নির্ণয়ে প্রতিনিয়ত ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে।
বন্য প্রাণী সংরক্ষণ, বনায়ন নজরদারি, ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা, শিকারির হাত থেকে অভয়ারণ্য রক্ষাসহ এই সম্পর্কিত নানা নজরদারির কাজে সার্থকতার সাথে ড্রোন বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এছাড়া বিভিন্ন স্তরে নিরাপত্তাজনিত নজরদারি, সুরক্ষা, জরুরি নির্গমণসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা স্তরে বিভিন্ন কাজে ড্রোনের ব্যবহার উল্লেখ করার মতো। এছাড়া ব্যক্তিগত এবং পেশাদারী পর্যায়ে ছবি তোলা এবং ভিডিও ধারণে আজকাল ড্রোনের ব্যবহার একটি প্রচলিত বিষয়। ড্রোনের ব্যবহারে একদিকে যেমন বিভিন্ন খাতে মানুষের প্রয়োজন অনেক কমেছে ঠিক তেমনি উল্লেখযোগ্য হারেও ব্যয় সংকুচিত হয়েছে।
ড্রোনের ঝুঁকিসমূহ
একদিকে যেমন ড্রোন নানা কাজে মানুষকে নানা সুবিধা এনে দিয়েছে ঠিক তেমনি এর কিছু নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিও রয়েছে। এক্ষেত্রে সব থেকে বিপদজনক দিকটি হচ্ছে- ‘ব্যক্তিগত তথ্য’ চুরি হবার বিষয়টি। ঠিক এই কারণেই পৃথিবীর অনেক দেশেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে ড্রোনের ব্যবহার আইনের মাধ্যমে সীমিত করা হয়েছে। এ প্রসংগে জেমস এ অ্যাচিভেদো বলেন-
ড্রোনের ব্যবহারে ব্যক্তিগত তথ্য চুরির মারাত্মক সম্ভাবনা সবসময়ই থাকে। যেকেউ সহজেই ড্রোনের মাধ্যমে একদিকে যেমন আপনার উপরে নজরদারি চালাতে পারে। ঠিক তেমনি D.J.I‘এর মতো জনপ্রিয় কিছু ড্রোন কোম্পানি খুব সহজে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য তৃতীয় পক্ষের কাছে খুব সহজেই পাচার করে দিতে পারে।
ড্রোনের উল্লেখযোগ্য আরও কিছু ঝুঁকি হচ্ছে-
নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থতা
সংঘর্ষ
ব্যাটারি নিঃশেষ হওয়া
নিয়ন্ত্রণজনিত ব্যর্থতা
তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সরবরাহগত ত্রুটি
দায়বদ্ধতা
আইনি বাধ্যবাধকতা
কাঙ্ক্ষিত কার্যদক্ষতায় গরমিল