আমি ক্লাসে সব সময় পড়া পড়ি। কখনোই কান ধরে ওঠবস করতে হয় না আমার। কিন্তু ক্লাসে একটু হাততালি আর হাসার কারণে আপায় আমারে বেত দিয়ে প্রথমে পিঠে আঘাত করেন। আমি চিৎকার করলে আপা আমার ঘাড়ে আঘাত করতে গেলে বেতটা আমার বাম চোখে লাগে। তারপর আপায় আমাকে আর কিছু না বলেই চলে যান। এরপর থেকে আমার বাম চোখে রক্ত পড়তে থাকে। আমার বন্ধুরা আমাকে ধরে আমার বাসায় নিয়ে আসে।’
শিক্ষকের বেত্রাঘাতের পরে হাসপাতালে নেওয়ার আগে এভাবেই নিজের কষ্টের কথা বলছিল মাদারীপুর শহরের দরগাখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সম্পা আক্তার।
গতকাল সোমবার বিদ্যালয়ে শিক্ষকের বেত্রাঘাতে আহত হয় সম্পা আক্তার। সম্পা শহরের পানিছত্র এলাকার সিরাজুল হক হাওলাদারের মেয়ে। সম্পার পরিবারের অভিযোগ, এ ঘটনা ধামাচাপা দিতে পরিবারটিকে প্রভাবশালী একটি মহল চাপ দিচ্ছে।
সম্পার বাবা সিরাজুল হক হাওলাদার বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করেন। অসচ্ছল এই পরিবারের একমাত্র মেয়ে সম্পার চোখের এ অবস্থা নিয়ে তিনি পড়েছেন বিপাকে। মেয়ের চিকিৎসায় দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ফুটফুটে মেয়েটা এখন বাঁ চোখে দেখতে পাচ্ছে না। মাদারীপুরে নিজের সাধ্যমতো চিকিৎসা করিয়েছি। এখনো চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। সকালে সম্পার আপারা এসে ১০ হাজার টাকা দিয়ে গেছে।’
সম্পার সহপাঠী ও পরিবারের অভিযোগ, গতকাল দুপুরে বিদ্যালয়ের বিরতির পরে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে বাংলা ক্লাস নিতে যান বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক দিল আফরোজ ওরফে রত্না। শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থাকা সবাই দাঁড়িয়ে শিক্ষককে সম্মান প্রদর্শন করে। এ সময় ওই শ্রেণির ছাত্রী সম্পা দুষ্টুমি করে হেসে ফেলে ও হাততালি দেয়। এতে শিক্ষক ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বেত্রাঘাত করেন। বেত্রাঘাতের একপর্যায়ে তার বাঁ চোখে গুরুতর আঘাত লাগে। গুরুতর অবস্থায় সম্পাকে তার সহপাঠীরা বাসায় নিয়ে আসে। সেখান থেকে পরিবারের লোকজন মাদারীপুর চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি করে। সম্পার চোখ দিয়ে এখনো রক্ত ঝরছে বলে জানিয়েছে তার পরিবার। সম্পার অবস্থার অবনতি হলে আজ মঙ্গলবার উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
সম্পার কয়েকজন সহপাঠী জানায়, তারা ক্লাসে একটু দুষ্টুমি করলেই শিক্ষকেরা বেত দিয়ে মারধর করেন। কিছু হলেই কারণে-অকারণে মারেন। তারা ভয়ে কিছু বলে না। সম্পাকেও এভাবে মারা হয়েছে। প্রথমে সম্পার চোখে তারা রক্ত ঝরতে দেখে ভয় পেয়ে যায়। পরে তারা সম্পাকে ধরে ওর বাসায় নিয়ে আসে।
সম্পার মা জিন্নাতুল নেছা বলেন, ‘মেয়েটি রাতে ঘুমানোর আগে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে, আম্মু আমি কি চোখে আর দেখতে পাব না? এ কথা শুনে আমার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শুধুই কেঁদেছি। মেয়েকে বোঝানোর ভাষাও আমার নেই। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আমার মেয়ের চোখটা আপনারা ফিরিয়ে দেন।’
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগটি সঠিক। আমি বিষয়টি শুনে আজ সকালেই সম্পাকে দেখতে যাই। তার বাঁ চোখে গুরুতর আঘাত লেগেছে। আমি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছি। ইতিমধ্যে অভিযুক্ত ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
মাদারীপুর চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসক এ আর অমিত বলেন, ‘ওই শিক্ষার্থীর চোখ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুরোপুরি সেরে উঠতে সময় লাগবে। পর্যাপ্ত চিকিৎসা না নিলে চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আমরা তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য গোপালগঞ্জে পাঠিয়েছি।’
অভিযোগ স্বীকার করে অভিযুক্ত শিক্ষক দিল আফরোজ বলেন, ‘বিষয়টি এভাবে গড়াবে বুঝতে পারিনি। আমি এ ঘটনায় অনুতপ্ত। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। আমি ওই ছাত্রীর বাবাকে বলেছি, ওর চোখের চিকিৎসায় যা খরচ হবে আমি দেব।’
মাদারীপুর মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) ইশতিয়াক আহম্মেদ বলেন, ‘আমরা ঘটনা শুনে ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে গিয়ে মেয়ের বাবার সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁকে থানায় অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। যদি তাঁরা অভিযোগ দেন, তবে অবশ্যই আমরা আইনি পদক্ষেপ নেব।’