আইদা গারিফুলিনাকে চেনেন? না চিনলে রাশিয়ানরা আপনার দিকে রক্তচক্ষু করে তেড়ে আসতে পারে। বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হচ্ছে আজ মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে, সে উৎসবের সবচেয়ে বড় পারফরমারদের একজন এই অপেরা সিঙ্গার—অথচ তাঁকে চেনেন না!
প্লাসিদো দোমিঙ্গো? ১৯৯০ সালের ইতালি বিশ্বকাপের সাউন্ডট্র্যাক তৈরি করা এই শিল্পীকেও চিনছেন না? লুসিয়ানো পাভারোত্তি, হোসে কারিরাস, হুয়ান দিয়েগো ফ্লোরেস? দূর, কাউকেই তো দেখি চিনতে পারছেন না! চার বছরের প্রতীক্ষা শেষে বিশ্বকাপ ফুটবলের আরেক মহাযজ্ঞের শুরু হবে যাঁদের সুরে সুরে, তাঁদের না চিনলে হয়!
সত্যটা হলো, তাঁদের চেনেই বা কজন! অন্তত ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে! দর্শকদের অপেক্ষা তো মাঠের ফুটবলের জন্য।
সেখানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ওই অপেরায় আগ্রহ কী! হ্যাঁ, লুঝনিকির গ্যালারির ৮০ হাজার সিটের একটিও আজ খালি থাকবে না। বিশ্বের নানা প্রান্তে টেলিভিশনের পর্দায়ও চোখ সাঁটা থাকবে অযুত-নিযুত-কোটি দর্শকের। কিন্তু তা ওই ফুটবলের রোমাঞ্চের আহ্বানে। অপেরার সুরের আবাহনের জন্য নয়। তবে আমাদের আমজনতার একেবারে অপরিচিতজনরা যে থাকবেন উদ্বোধনী উৎসবে, তা-ও না। রবি উইলিয়ামস থাকছেন। তাঁকে তবু চেনার কথা, গান না হলেও অন্তত নাম শোনা পর্যন্ত! নব্বইয়ের দশকের পপ আইকন ইংল্যান্ডের এই শিল্পী। আজকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বড় আকর্ষণ হয়ে থাকবেন তিনিও। অবশ্য ফুটবলের ভক্তরা যদি রবি উইলিয়ামসকে না চেনেন, তাহলে তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর উপায় নেই।
আর আছেন এক ফুটবলের প্রতিনিধি; ফুটবলারদের প্রতিনিধি। দু-দুটি বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য এক কিংবদন্তি। ২০০২ সালে তো ব্রাজিলকে তাদের সর্বশেষ শিরোপা জিতিয়েছেন রূপকথার পারফরম্যান্সে। আট গোল করে টুর্নামেন্টের ‘গোল্ডেন বুট’ জিতে। এর আগের বিশ্বকাপ দল না জিতলেও নিজে জিতেছিলেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার ‘গোল্ডেন বল’। রোনালদো লুইস নাসারিও দি লিমা।
বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে বাংলাদেশের উন্মাদনা অবিশ্বাস্য। পুরো দেশ ভাগ হয়ে যায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায়। এই যে কাল মেসি-আগুয়েরো-দি মারিয়াদের অনুশীলন দেখার জন্য মস্কো থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের ব্রোনিিসতে ছুটে গেলাম, সেখানেও পরিচয় পাওয়ার পর আর্জেন্টাইন সাংবাদিকদের এ নিয়েই প্রশ্ন। তাতে ধারণা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক যে বিশ্বকাপের দেশ রাশিয়ায় না জানি কী কাণ্ড হচ্ছে!
ব্যাপারটি আদতে তেমন নয়। এই যে দোমেদেদোভো বিমানবন্দর থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মস্কো শহরে এলাম দিন দুয়েক আগে, পথের পাশে বিশ্বকাপের চিহ্ন তাতে সামান্য। আর্জেন্টিনার অনুশীলন ক্যাম্প উপলক্ষে ব্রোনিিসর আলাদা উৎকট বিজ্ঞাপন নেই। যা আছে, তা শালীন ও সামান্য। ঢাকার শহরতলি আশুলিয়া বা সাভারে যদি আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের মতো দল বিশ্বকাপের ক্যাম্প করত—তাহলে যা হতো, এর কিছুই নেই সেখানে। তাই বলে বিশ্বকাপ নিয়ে রুশদের উৎসাহ নেই, তা ভাববেন না যেন। অন্য দেশ থেকে আসা সমর্থকদের উচ্ছ্বাসের কমতি আছে—অমন মনে করার কারণও নেই। তিন দিন বন্ধ থাকার পর খুলে দেওয়া রেড স্কয়ারে গেলে কিংবা কার্ল মার্ক্স চত্বর, উল্টোদিকের বলশোই থিয়েটার—সেখানে উৎসব ছড়াচ্ছে হাজার রঙের ফোয়ারা। একটি রঙিন ছবি যেন সেখানে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতির ডানায় ভর করে।
আজ লুঝনিকির সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের রংও এখানে এসে পড়বে নিশ্চিতভাবে। মস্কোভা নদীর ওপরের সেতুতে পতপত করে কাল উড়ছিল যে শত শত পতাকা, সেখানেও খেলে যাবে উচ্ছ্বাসের ঢেউ। রাশিয়া-সৌদি আরব ম্যাচ দিয়ে শুরু মাঠের লড়াই, এর আধঘণ্টা আগে হবে অনুষ্ঠানটি। মস্কো শহরের বিভিন্ন জায়গায় বড় পর্দায় সেটি তো দেখানো হবেই, রেড স্কয়ারে হবে কনসার্ট। তাতেই মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা কিংবা ইংল্যান্ড-জার্মানি অথবা জাপান-ইরান-সৌদি আরবের দর্শকরা।
অপেরা সংগীতের মহান শিল্পীরা থাকবেন আজ লুঝনিকিতে; পপ আইকনও। কিন্তু ভাষা তো সেই ফুটবলের। আর সেই ভাষায় বিশ্বের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করায় রোমাঞ্চ খেলে যায় তাই রবি উইলিয়ামসের কথায়ও, ‘আমি খুব আনন্দিত। ক্যারিয়ারে অনেক বড় জায়গায় পারফর্ম করেছি। তবে বিশ্বকাপের উদ্বোধন উপলক্ষে স্টেডিয়ামের ভেতরের ৮০ হাজার এবং বিশ্বজোড়া মিলিয়ন মিলিয়ন দর্শকের সামনে এমনভাবে পারফর্ম করবে। এটি তো আমার শৈশবের স্বপ্ন। ফুটবল ও সংগীতের সমর্থকদের উৎসবে স্বাগত জানাচ্ছি। ’
ফুটবলের প্রতিনিধি হয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকা রোনালদোর কাছে এর গুরুত্ব অন্য রকম। আর তা কী সুন্দরভাবেই না বুঝিয়ে বলেন তিনি, ‘বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ সব সময়ই তাৎপর্যপূর্ণ। খেলোয়াড় ও দর্শক হিসেবে এ সময়ই বুঝতে পারি, চার বছর পর অবশেষে সেই মুহূর্ত আবার ফিরে এসেছে। কেউ জানে না, সামনের চার সপ্তাহে কী হবে। তবে সবাই নিশ্চিত যে স্মরণীয় কিছুই হবে। ’ সর্বকালের অন্যতম সেরা এই স্ট্রাইকার স্বাগতিকদের আবেগটাও বুঝতে পারছেন চার বছর আগে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে, ‘স্বাগতিকদের জন্য এটি খুব আবেগের মুহূর্ত। এত বছরের পরিশ্রমের পর হঠাৎই পুরো বিশ্ব যেন আপনার উঠোনে এসে পড়েছে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা উদ্যাপনের জন্য। চার বছর আগে ব্রাজিলে আমি এ অনুভূতির ভেতর দিয়ে গিয়েছিলাম। এখন রাশিয়ায়ও একই রোমাঞ্চের অংশ হতে পারছি। সে জন্য আমি খুব খুশি। ’
রোনালদোর কথাই ঠিক। তাঁর রোমাঞ্চ, তাঁর আনন্দ বিশ্বের সব ফুটবলপ্রেমীর কণ্ঠস্বর। বিপ্লবী ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের দেশে এবার কোন ফুটবল-বিপ্লব হয়, কে জানে! তবে অপেক্ষা নিয়ে বসে আছে সবাই। সময়টাই যে এখন ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা উদ্যাপনের! কালের কণ্ঠ