ava desk : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় অনেকটা নির্ভার থেকে নির্বাচন করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে—এটি ধরে নিয়েই এখন থেকে মাঠ গোছাতে শুরু করেছে তারা। বিএনপি নির্বাচনে এলে আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে এবং এ ক্ষেত্রে দলের ‘গোছানো তৃণমূল’ জয়ে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকেরা।
অন্যদিকে, তৃণমূল নেতারা জয় পেতে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত নেতাদের মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলছেন। রাজনীতির সঙ্গে তেমন যুক্ত নন—এমন ব্যক্তিদের মনোনয়ন না দেওয়ার পক্ষে তাঁরা। এ ছাড়া রাজনীতির বাইরের কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার পক্ষে নন তাঁরা।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বৃহস্পতিবার সংসদীয় দলের বৈঠকে সাংসদদের উদ্দেশে বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে—এটা ধরে নিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিন।’ এবারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। এ জন্য তিনি দলের নেতা-কর্মীদের প্রস্তুতি নেওয়ার কথাও বলেছেন।
দলের সভানেত্রীর নির্দেশনার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ দলটির সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে বৈঠক করেছে। গত রোববার ঢাকা জেলা, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, গাজীপুর মহানগর, নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ মহানগর ও মুন্সিগঞ্জের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং সংশ্লিষ্ট জেলা-মহানগরের অন্তর্গত দলীয় জাতীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে যৌথসভা করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।
জানা গেছে, এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রোববার যৌথসভায় ঢাকার আশপাশের এসব জেলার নেতা ও সাংসদদের দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ মনে করে, জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা এবং ঢাকার আশপাশ ঠিক রাখতে পারলে সারা দেশে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ কারণে এখান থেকেই দল গোছানোর কাজ শুরু করতে হবে।
আওয়ামী লীগের জাতীয় সংসদ নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ঢাকার আটটি আসনের সব কটিই পেয়েছিল বিএনপি। ঢাকার আশপাশেও তারা ভালো করেছিল। ওই নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় যায়। পরের বার ১৯৯৬ সালে উল্টো ফল হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ওই সদস্য বলেন, ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের মানুষের মনোভাব ও চিন্তার একটা প্রতিফলন সারা দেশের মানুষের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়। এখন গণমাধ্যমের কারণে এটি আরও বেশি হয়। ফলে আওয়ামী লীগ ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোয় নিজেদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করতে চায়। একইভাবে সারা দেশেই দলকে শক্তিশালী করতে চায়।
সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আর সর্বোচ্চ ছয় মাস বাকি আছে। নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে ইতিমধ্যে দলটি তিনটি বিশেষ বর্ধিত সভাও করেছে। এসব সভায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মহানগর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতারা অংশগ্রহণ করেছেন। সভাগুলোয় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তৃণমূলের সঙ্গে সভা করেছেন দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি থাকলে সেটি নিরসনই এই সভার উদ্দেশ্য। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য সবাই মিলে একত্রে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া দলের প্রয়োজনে ত্যাগ স্বীকারের জন্যও যেন নেতা-কর্মীরা প্রস্তুত থাকেন, সেটিও সভাগুলোর অন্যতম উদ্দেশ্য।
দলের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিভেদ-কোন্দল মেটাতেই বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি তৃণমূল নেতাদের দলীয় কোন্দল মেটাতে, বিভেদ ভুলে নৌকার জন্য এক হয়ে কাজ করতে, দলের ভেতরে ‘অনুপ্রবেশকারী’ নেতা-কর্মীদের থেকে সাবধান হতে এবং দলের কেন্দ্র থেকে দেওয়া নির্দেশ পালন করতে সবাইকে নির্দেশনা দেন। বিশেষ সভায় নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতাদের কথাও শোনেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বলছেন, ১০ বছর ধরে দল ক্ষমতায় থাকায় তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে দলের সভানেত্রীর যোগাযোগ কিছুটা কমে গিয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছিল। এই দূরত্ব কমাতেই প্রথমবারের মতো তৃণমূল নেতাদের নিয়ে এমন বিশেষ বর্ধিত সভা করা হলো। প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াতে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত বিশেষ বর্ধিত সভায় অংশ নেওয়া তৃণমূল নেতারা অভিভূত হয়েছেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন এবং ভবিষ্যতে একত্র থেকে দলকে জেতানোর জন্য প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সামনে কথা বলতে পারার সুযোগ এবং ‘সম্মান’ পাওয়ায় তাঁরা দলীয় প্রধানের কাছে অভাব-অভিযোগের তুলনায় একসঙ্গে নৌকার হয়ে কাজ করার বিষয়ে দৃঢ় মনোভাব প্রকাশ করেন।
তৃতীয় ও শেষ দিনের বিশেষ বর্ধিত সভায় তৃণমূল থেকে গণভবনে আসা নেতারা সবাই প্রধানমন্ত্রীর সামনে বক্তব্য দিতে পারেননি। এ কারণে তৃণমূলের অনেক নেতা দলের সভানেত্রীর কাছে একটি করে চিঠি দিয়ে গেছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের কথা জানতে চান—এ কারণে তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী এসব চিঠি লিখে গেছেন তাঁরা।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত—এমন ব্যক্তিদেরই যেন মনোনয়ন দেওয়া হয়, সে বিষয়ে দলের সভানেত্রীর কাছে আহ্বান জানিয়ে গেছেন তৃণমূল নেতারা। বিষয়টি দলও গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে। এর আগে ‘কৌশলগত কারণে’ দলের বাইরের কিংবা রাজনীতির সঙ্গে কম সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচনে প্রার্থী করায় দলের তৃণমূল থেকে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছিল আওয়ামী লীগ। বিশেষ বর্ধিত সভায় এবার সেই বিষয় আবারও সভানেত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন নেতারা।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় দলীয় কোন্দলের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কোন্দলের কারণে সারা দেশে দল ও দলের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের খবরও পাওয়া গেছে। দল ক্ষমতায় থাকলে এসব ঘটনা ‘টুকটাক’ ঘটে, কিন্তু সেটি যেন বড় ধরনের কোনো সমস্যা তৈরি করতে না পারে, সেটি নিয়ে ভাবছে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন নেতৃত্ব প্রাধান্য পাবেন বেশি। বিষয়টি প্রাধান্য দিতে গিয়ে অনেক এলাকায় মতপার্থক্য দেখা দিতে পারে। এই মতপার্থক্য যেন মতবিরোধে পরিণত না হয়, সেটি নিয়ে ভাবছে দল।
তা ছাড়া দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মনোনয়ন না দেওয়ার বিষয়ে চিন্তা করছে আওয়ামী লীগ। যেসব নেতা কিংবা সাংসদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ আছে, তাঁদের মনোনয়ন না দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আছে দলের। এ ক্ষেত্রে মনোনয়নবঞ্চিত ব্যক্তি যদি দলের জন্য কাজ না করেন কিংবা ভূমিকাহীন থাকেন, তাহলে দল কীভাবে কাজ করবে, সেটিও ভাবাচ্ছে আওয়ামী লীগকে।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেক এলাকা আছে, যেখানে তিনজন কিংবা চারজন প্রার্থী সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। এই ব্যক্তিরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের কাকে ছেড়ে কাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে, আর প্রাধান্য দিলে অপর তিন প্রার্থীর মনোভাব বা ভূমিকা কী হবে, এসব বিষয় ভাবনায় নিয়েই দলের পক্ষ থেকে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মেনে চলার জন্য তৃণমূল নেতাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে অনেক বড় ভূমিকা থাকে তৃণমূলের, এ কারণে তৃণমূল নিয়ে বেশি চিন্তা করা হচ্ছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখন কারাগারে আছেন। তিনি কারাবন্দী থাকলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে জানিয়েছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। কিন্তু বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, এবার নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির ভবিষ্যৎ কী হবে? বিএনপি কি আদৌ দেশের রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারবে? এসব প্রশ্নের বিপরীতে বিএনপি মনে করে, যেভাবেই হোক বিএনপি একটি ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের অধীনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার মতো ‘ভুল’ এবার বিএনপি করতে চায় না।
বিএনপির এই ভাবনার বিষয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নজর রাখছে। আওয়ামী লীগ মনে করছে, বিএনপি এরই মধ্যে প্রায় এক যুগের মতো সময় ক্ষমতার বাইরে। এই সময়ের মধ্যে গত দশম জাতীয় নির্বাচন ঠেকাতে গিয়ে দলটি যে নেতিবাচক রাজনীতি করেছে, তা তারা বুঝতে পেরেছে। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জেল হওয়ার পরও দলটির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখে। এ কারণে এবার বিএনপি কোনোভাবেই নির্বাচন ‘মিস’ করতে চাইবে না বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের ধারণা।
prothomalo